Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Nadia

১৮ বছর ধরে নিজেকে জীবিত প্রমাণের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ! ‘মরে প্রমাণ করব, যে আমি মরিনি?’

১৮ বছর ধরে দরিদ্র রবীন্দ্রনাথ প্রাণপণে লড়াই করে চলেছেন নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে। স্ত্রী জানাচ্ছেন, কিছু না হলে তাঁকে বিধবা ভাতা দিক সরকার। তাতে স্বামীকে নিয়ে খেয়েপরে বাঁচতে পারবেন।

Old man of Nadia is fighting for 18 long years to prove that he is alive

৮ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে পারেননি ভীমপুরের রবীন্দ্রনাথ। —নিজস্ব চিত্র।

প্রণয় ঘোষ
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৩ ১৬:২৮
Share: Save:

ঠিক সিনেমার মতো। উত্তরপ্রদেশের কৃষক লালবিহারীর জীবন আধারে তৈরি হয়েছিল ‘কাগজ’ সিনেমাটি। ভূমি দফতরের নথিতে ১৯৭৬ থেকে ’৯৪ সাল— প্রায় ১৮ বছর জীবিতকে মৃত হিসাবে দেখানো হয়েছিল সিমেনায়। একটা সংলাপও খুব জনপ্রিয় হয়, ‘‘এই মড়ার মতো পড়ে ছিল! আবার এই উঠে কোথায় চলে গেল?’’ সিনেমার মতো নদিয়ার ভীমনগরের রবীন্দ্রনাথ গড়াইয়ের ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তির বয়সটা ঠিক ১৮ বছর। ২০০৫ থেকে ২০২৩— এখনও জেলাশাসক থেকে পুলিশ-প্রশাসনের বিভিন্ন সরকারি দফতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। না, কোনও পরিষেবা পাওয়ার জন্য নয়। তিনি যে বেঁচে আছেন, তা প্রমাণ করার চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী রবীন্দ্রনাথ।

ভুল সরকারি নথির গেরোয় রোজগারের পথ খুইয়েছেন। স্থানীয় ব্লক অফিসের অস্থায়ী কাজ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। সংসার চালাতে দেনার ভারে রিক্ত তিনি। তবু অশক্ত শরীরে নিজেকে জীবিত প্রমাণের চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে প্রশাসনের সাফাই, ‘‘অনেক পুরনো ঘটনা।’’

স্থানীয় সূত্রে খবর, নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর ১ নম্বর ব্লকের ভীমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ। ২০০১ সালে কৃষ্ণনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির ‘ব্লক স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা’র একটি কাজে যোগ দেন রবীন্দ্রনাথ। অস্থায়ী পদে কাজ করছিলেন। কিন্তু ওই বছরই একটি পথদুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে জখম হন রবীন্দ্রনাথ। চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন। এখনও শরীরের ৬০ শতাংশ জায়গায় সাড় নেই তাঁর। রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ, তিনি কাজ করতে অসমর্থ। এই কারণ দেখিয়ে ওই কাজ থেকে সরানোর চক্রান্ত হচ্ছিল। যদিও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ২০০৩ সালে পদোন্নতি হয় রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সেই নির্দেশ ব্লক অফিসে এসেই আটকে যায়। আচমকাই কাজ হারান রবীন্দ্রনাথ।

কাজ হারিয়ে আইনি লড়াই শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। একে একে বিডিও, মহকুমাশাসক, জেলাশাসক-সহ একাধিক সরকারি দফতরে ছুটেছেন। অভিযোগ করেছেন, তাঁকে অন্যায় ভাবে কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তদন্তের আবেদন করেন। ২০০৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসন একটি তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার পরেই ঝটকা। রবীন্দ্রনাথের বরখাস্ত প্রসঙ্গে দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০০৫ সালে মৃত্যু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের!

বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ এর বিহিত চেয়ে স্বশরীরে জেলা পুলিশ সুপারের অফিসে গিয়ে তদন্ত দাবি করেন। পুলিশ তদন্তও শুরু করে। ২০০৭ সালে কৃষ্ণনগরের তৎকালীন ডিআইবি কর্তা তদন্ত করে জানান, রবীন্দ্রনাথ গড়াইয়ের নামে একটি মৃত্যুর শংসাপত্র জমা দিয়েছে দফতর। পরবর্তী সময়ে একাধিক মামলায় উঠে আসে মৃত ব্যক্তির বাবার নাম ও বয়সের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গড়াইয়ের মিল নেই।

স্ত্রী এবং ৩ ছেলেকে নিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো অবস্থা রবীন্দ্রনাথের। বড় ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন। প্রতি মাসে তাঁর চিকিৎসায় কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়। ছোট ছেলে বেকার। স্ত্রী অসুস্থ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও প্রতিবন্ধী। মেজো ছেলের সামান্য উপার্জনে কোনও রকম সংসার চলে। অন্য দিকে, ১৮ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে পারেননি ভীমপুরের রবীন্দ্রনাথ। তাঁর স্ত্রীর কথায়, ‘‘সরকার মেনে নিক আমার স্বামী জীবিত। না হলে আমায় একটা বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দিক। তাতে আমরা খেয়েপরে বাঁচি।’’

রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ, ‘‘এক সময়ে জেলার এক আধিকারিক আমার কাছে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। আমরা দিনমজুর মানুষ। অত টাকা কোথা থেকে দেব? এর পরেই দুর্ঘটনা হল। সেই অজুহাতে কাজ থেকে সরিয়ে দিল আমায়। পরে কাগজ ঘেঁটে জানলাম, আমি নাকি মৃত!’’

এ নিয়ে কৃষ্ণনগর-১ নম্বর ব্লকের বিডিও পিন্টু ঘরামির সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। তিনি বলেন, ‘‘অনেক দিন আগের ঘটনা। তবে শুনেছি মৃত্যুর শংসাপত্র নিয়ে কোনও একটা গন্ডগোলের জেরে একটা সমস্যা হয়েছে। সেই সময় জেলাস্তর থেকে বেশ কিছু তদন্ত হয়েছিল। এর বেশি আমি কিছু জানি না।’’

‘কাগজ’ সিনেমার শেষ অংশে ১৯৯৪ সালে জেলা প্রশাসন ওই ত্রুটিযুক্ত নথি সংশোধন করে। ফলে রেকর্ড থেকে লালবিহারীর মৃত অন্তর্ভুক্তি বাতিল হয়ে যায়। লালবিহারী ১৮ বছর ধরে লড়াই করে প্রমাণ করেই ছাড়েন যে, তিনি জীবিত। তবে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই লড়াই করতে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, তাঁকে কি ‘দেনা পাওনা’র গল্পের কাদম্বিনীর মতো মরে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি মরেননি! তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মরে প্রমাণ করব যে, আমি মরিনি?’’

অন্য বিষয়গুলি:

Nadia death certificate Krishnagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy