সেভেন পর্যন্ত কিছু বুঝতে পারেনি। ক্লাস এইট-এ উঠে সহপাঠীদের রসিকতা তাকে বুঝিয়ে দিল, এ নাম পাল্টানো দরকার। সৌভাগ্য, বাড়ির লোকেরা অসহযোগিতা করল না। ফল, মিরণ শেখ এফিডেভিট করে এখন ইয়ামিন আলি। নবাবের দেশে বাস করে নবাব-ঘাতকের নাম নিয়ে বাঁচা যে খুব সহজ নয়, এইটুকু বয়সে ইয়ামিন টের পেয়েছে বিলক্ষণ।
আসলে, শেক্সপিয়র যতই বলে যান, নামে কী বা যায় আসে, নামে কিন্তু অনেকটাই আসে যায়। আমাদের গ্রামের পাঁচুদার কথাই ধরা যাক। পাঁচুদা তো চিরকাল আক্ষেপ করে গেলেন, জীবনে বড় কিছু হয়ে ওঠার পথে তাঁর প্রথম কাঁটা ছিল নাম। যে কোনও চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত হয়ে, নাম ‘পাঁচুগোপাল’ বলতেই নাকি বোর্ডে বসা পরীক্ষকদের ভুরু কুঁচকে যেত।
এ হয়তো পাঁচুদার নাম নিয়ে হীনম্মন্যতা। কিন্তু এ যুগে কারও নাম গোবর্ধন বা পাঁচুগোপাল কিংবা ষষ্টীচরণ হলে নাম নিয়ে সে কোথাও একটুও মশকরার মুখোমুখি হবে না, এখনও এতটা আধুনিক বোধহয় হয়ে ওঠেনি আমাদের সমাজ। আর কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হলে তো অনেকেই তাকে মনে করিয়ে দেবে যে, একেবারে বিপরীত পাত্রে পড়েছে নামটা। নাম নিয়ে অন্য সমস্যাও কম নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী মধ্য নাম ‘কুমার’ ও ‘চন্দ্র’ ত্যাগ করেছিলেন। আমরা অনেকেই ব্যবহারিক জীবনে এ রকম করেই থাকি। কিন্তু কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজে এই পরিবর্তন অনেক সময়েই করা হয়ে ওঠে না। ফলে এই সব মধ্য নাম অনেক সময়েই সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজিতে কেউ আপনার চেক বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ নথিতে ‘কুমার’ বা ‘চন্দ্র’ লিখবেন তো কেউ ‘কে আর’ বা ‘সি এইচ’ লিখে ডট চিহ্ন দিয়ে সারবেন, আবার কেউ পুরো মধ্যনামটির পাটই তু্লে দেবেন। তখন ঝামেলা মেটাতে আপনাকে ছুটতে হবে কোর্টে। সংক্ষিপ্ত এবং অনুপস্থিত মধ্যনামযুক্ত সব ক’টি নামেরই অধীশ্বর যে একই ব্যক্তি এবং সে ব্যক্তি যে আপনিই, এই মর্মে সেখান থেকে বের করতে হবে হলফনামা।
একই সমস্যা ‘হক’, ‘শেখ’ এর ইংরেজি বানানের ক্ষেত্রেও। এখানে ‘এইচ কে’ ‘এস কে’ যেমন চলে তেমনি পুরো বানান লেখারও চল আছে। এবং সেই পুরো বানানেও বানানভেদ রয়েছে। সমস্ত অফিসিয়াল কাগজপত্রে এই জাতীয় ‘পদবি’ কারও ঠিকঠাক পেয়ে ওঠা রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আর নামের ক্ষেত্রে বানান তো হামেশাই এদিক সেদিক। শিশির, শুভশ্রী, শ্যামশ্রী জাতীয় নামের ইংরেজি বানানের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাবা মায়েরাও ঠিক করে উঠতে পারেন না, দুটো ‘এইচ’ রাখবেন না একটা ‘এইচ’। কেউ একটা ‘এইচ’ও না রাখলে কিছুটা স্বস্তির। কিন্তু ইংরেজি বানানে একটা বা দুটো ‘এইচ’ রাখলে কোথায় না ভুল হবে। যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টে নাম ঠিকানা ওঠান তাঁদের খেয়ালখুশি, অজ্ঞতা, অসাবধানতাজনিত ভুলে এমনিতেই সাধারণ নামের মানুষেরা জেরবার, তার উপর নাম পদবির এই রকম একটু জটিলতা থাকলে সমস্যা আর দেখতে হবে না।
শংসাপত্রের নাম, পদবিতে সংশোধন নিয়ে আগে সচেতনতা কম ছিল, হ্যাপাও ছিল বিস্তর। অনেকে সংশোধনের রাস্তা এড়িয়ে ‘যা আছে তাই থাক’ বলে রেখে দিতেন। এনআরসি জুজুতে ভীত বাঙালির এখন সে সব ডকুমেন্ট হাতড়াতে গিয়ে ভাঁজ পড়ছে কপালে। তখনকার ভুল কী ভাবে সংশোধিত হবে এত দিন পরে? অনেকে ছুটছেন বাল্যের বিদ্যালয়ে, এলাকার বিডিও অফিসে বা জেলা-হাসপাতালে।
আর বিভিন্ন শংসাপত্রের ভুলের সঙ্গে, গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এখন চেপে বসেছে আধার কার্ড ভোটার কার্ডের নানা ভুল। একে তো সংশোধন কেন্দ্রের সংখ্যা এলাকায় একটি বা দু’টি, তার উপর আধারকার্ড, ভোটারকার্ডের ভুল ঠিক হতেই চায় না। বার বার সংশোধনেও কিছু না কিছু রয়ে যায়। এ সব ভুল সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত কম্পিউটার জ্ঞানই যে যথেষ্ট নয়, দরকার এর সঙ্গে বেশ কিছুটা শিক্ষাগত যোগ্যতাও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা মনে রাখা হয় না এই কাজের কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে। ফলে এ বাবদে হয়রানি আমাদের লেগেই থাকে। আধারকার্ড, ভোটারকার্ড সংশোধনের জন্য বিভিন্ন পোস্টঅফিস, বিডিও অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইন রোজকার চিত্র।
এই নাম-পদবি নিয়েই আমাদের এক শিক্ষক সে দিন অন্য এক সমস্যার কথা পাড়লেন। শিক্ষকের নাম রফিকুল হাসান, বাবার নাম জয়নাল আবেদিন। বাবার নামে রয়েছে বাড়ির পুরনো দলিল। বাবা-ছেলের দু’জনের নামের শেষাংশের এমন ভিন্নতা বহু ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক নয়। এনআরসি নিয়ে ভয়-বিভ্রান্তি এখন এতটাই যে এটাও ভাবাচ্ছে তাঁকে। এবং হয়তো অনেককেই।
বিদ্রূপ, বিপত্তি কি ভবিষ্যতে নামকরণের ক্ষেত্রে ছাপ ফেলবে কিছু? নামকরণের বিবর্তন কিছু কম হয়নি এ যাবৎ। বাংলায় পাঁচ বা পাঁচের অধিক অক্ষরের নাম এখন দেখা যায় কম। ‘শ্রী’র নানা ইংরেজি বানান দেখে আমরা ‘শ্রী’বর্জিত হয়েছি বহুদিন। মধ্যনাম ‘কুমার’, ‘চন্দ্র’, ‘নাথ’, ‘ময়’, ‘মোহন’, ‘চরণ’ ইত্যাদি খানিকটা ওই কারণেই হোক বা অনাবশ্যক হয়ে ওঠার পথে। আর মিরণ বা পাঁচুগোপাল জাতীয় নামও অভিভাবকেরা যে এড়িয়ে যাচ্ছেন, তা টের পাই শিক্ষকতাসূত্রে প্রতি বছর নানা নামে চোখ বুলিয়ে। অন্য দিকে বাবা ও ছেলের নামের শেষাংশের যে ভিন্নতা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের নামের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যেত সেখানেও সমস্যা এড়াতে দেখছি একইরকম রাখছেন অনেক অভিভাবক।
নামের ক্ষেত্রে জাতি সম্প্রদায়ও তত গুরুত্বপূর্ণ নয় আজকাল। রোহন, রানা, ইমন, সুপ্রিয় জাতীয় নাম এখন সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই। আগে নাম দেওয়ার ব্যাপারে কবি-সাহিত্যিকেরা বেশ প্রাধান্য পেতেন। একসময় ছেলেমেয়ের নাম রাখার ব্যাপারে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হতেন। রবীন্দ্রনাথ পরিচিতজনেদের সন্তানসন্ততির নাম দিতে ভালও বাসতেন। এখন কবি-সাহিত্যিকদের জায়গায় রয়েছে ইন্টারনেট, মুদ্রিত নামকরণ অভিধান। বেশিরভাগ পরিবারে এখন একটি-দু’টি সন্তান। তাই নাম রাখা নিয়ে আবেগ আগের চেয়ে অনেক বেশি। বেশি সতর্কতাও। কিন্তু সতর্কতা শুধু নাম রাখার বেলায় থাকলেই তো হবে না যাঁরা এই সব নাম গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে তুলবেন তাঁদের মধ্যে কী ভাবে সে-সতর্কতা সঞ্চারিত করা যাবে, প্রশ্ন সেটাই।
স্কুলশিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy