Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রাচীন মন্দির ঢেকেছে বটের ঝুরিতে

নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “ভবতারণ শিবমন্দিরের স্থাপত্য বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। অষ্টকোণাকার, আচ্ছাদিত বারান্দা সমেত এই শিবমন্দিরটি ব্যতিক্রমী নির্মাণশৈলী বহন করছে।” 

মন্দির বলে চেনা দায়। নবদ্বীপে। নিজস্ব চিত্র

মন্দির বলে চেনা দায়। নবদ্বীপে। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯ ০৩:৪৪
Share: Save:

নদিয়ার সিংহাসনে তখন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের পুত্র রাঘব। ধর্মপ্রাণ রাজা রাঘব তাঁর রাজত্বের শেষ পর্বে নবদ্বীপে গঙ্গার ধারে শিব এবং গণেশের জোড়া মন্দির সমেত মূর্তি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। সময়টা ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দ। গণেশ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার অল্প কালের মধ্যেই মারা গেলেন রাঘব। পাশে প্রকাণ্ড শিব মন্দিরের কাজ তখনও শেষ হয়নি। অসম্পূর্ণ সেই কাজ সমাপ্ত করলেন তাঁর পুত্র রুদ্র রায়। বাবার নাম অনুসারে সেই প্রকাণ্ড শিবের নাম রাখা হল রাঘবেশ্বর। প্রাচীন নবদ্বীপের ইতিহাসে সুরম্য সেই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রায় একশো বছর পরের কথা। সময়টা ১৭৬০ সাল। নবদ্বীপ প্রথম গঙ্গার ভাঙন দেখল। তখন নবদ্বীপের গঙ্গা শহরের দক্ষিণ দিক দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বইত। সেই ভাঙনে আরও অনেক কিছুর মতো ওই জোড়া মন্দির নদীগর্ভে যাওয়ার উপক্রম হল। তখন নদিয়ায় রাজত্ব করছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। তড়িঘড়ি ওই দুই বিগ্রহ নদী-তীরবর্তী মন্দির থেকে সরিয়ে আনা হল নগরের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু নতুন করে পুজো শুরুর আগে উঠল আপত্তি। স্থানান্তরের সময় বিশালাকায় দুই বিগ্রহ বহু মানুষের ছোঁয়ায় নাকি অপবিত্র হয়েছে। তাই শোধন না করে পুজো করা যাবে না ওই বিগ্রহের। পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন, বারো বছর দু’টি বিগ্রহ মাটির তলায় পুঁতে রাখলে নাকি দেবত্ব ফিরে পাবেন শিব এবং গণেশ। তাই হল। এই ঘটনা ১৭৬০-৬২ সালের মধ্যবর্তী কোনও সময়ের।

কিন্ত বারো বছর কেটে গেলেও মাটির নীচ থেকে তোলা হল না জোড়া বিগ্রহ। বেশ কয়েক বছর বিস্মরণের পর ওই বিগ্রহের খোঁজ পড়ল কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজ গিরিশচন্দ্রের আমলে। ১৮০২ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। তাঁরই উৎসাহে মাটির নীচ থেকে তোলা হয় গণেশ এবং রাঘবেশ্বর শিব। এ বার অন্য বিপত্তি। মাটি খুঁড়ে তুলতে গিয়ে ভেঙে গেল গণেশের শুঁড়। অঙ্গহানি হওয়ায় ওই গণেশ মূর্তি পুজোর অযোগ্য বলে বিবেচিত হল। রাজার ইচ্ছায় এবং পণ্ডিতদের পরামর্শে অজ্ঞাতপরিচয় কোনও শিল্পী ভগ্ন গণেশমূর্তি থেকে তৈরি করেন মহারাজ গিরিশ্চন্দ্রের আরাধ্যা দেবী আনন্দময়ীর মূর্তি। তাঁর নামকরণ হল ভবতারিণী। নবদ্বীপ পোড়ামা প্রাঙ্গণের এক দিকে প্রতিষ্ঠা হল ভবতারিণী আর অন্য দিকে সেই শিবলিঙ্গ। নতুন নামকরণ হল ভবতারণ শিব। সময়টা ১৮২৫ সাল।

প্রায় দু’শো বছরের প্রাচীন মন্দিরে সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো ভবতারিণী বিগ্রহ নবদ্বীপের ইতিহাসের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলির অন্যতম। প্রাচীন এক বটগাছের ঝুরি জড়িয়ে রেখেছে গোটা মন্দিরকে। ক্রমশ ভেঙে পড়ছে ভবতারিণী ও ভবতারণ শিবের মন্দির।

নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “ভবতারণ শিবমন্দিরের স্থাপত্য বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। অষ্টকোণাকার, আচ্ছাদিত বারান্দা সমেত এই শিবমন্দিরটি ব্যতিক্রমী নির্মাণশৈলী বহন করছে।”

বটগাছ না কেটে মন্দিরের কিছু সংস্কারের কাজ ভক্তদের দানে করেছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। সেবায়েত মানিকলাল ভট্টাচার্য বলেন, “ওই বটগাছে হাত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গাছ বাদে মন্দিরের মেঝে, দেওয়াল, বারান্দা, সিঁড়ি, দরজা— সব কিছুরই সংস্কার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।”

নবদ্বীপকে হেরিটেজ শহর ঘোষণা করার জন্য যে ৮৬টি স্থানের প্রাথমিক তালিকা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্মারক ওই জোড়া বিগ্রহ। একই সঙ্গে ইতিহাসে পোড়ামা মন্দির চত্বরের গুরুত্ব অপরিসীম। নব্য ন্যায়ের পীঠস্থান হিসাবে নবদ্বীপের খ্যাতি যখন ভারতজোড়া, তখন সংস্কৃত শাস্ত্রের যাবতীয় চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং উপাধি প্রদান অনুষ্ঠিত হত পোড়ামা তলার ওই বটমূলে।

কয়েকশো বছরের ঐতিহ্য অবশ্য এখন মুখ ঢেকেছে সারি সারি দোকানে।

অন্য বিষয়গুলি:

Nabadwip Temple Banyan Tree
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy