অভিযুক্ত টিঙ্কু সুতারের খোঁজে রেস্তরাঁয় হানা পুলিশের। মঙ্গলবার রানাঘাটে। ছবি: সুদেব দাস
উপনির্বাচন মিটতেই ফের প্রকাশ্যে এল নদিয়া জেলায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সোমবার রাতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে দলেরই বুথ সভাপতি ও দুই কর্মীকে পিস্তলের বাট দিয়ে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার সকালে ওই ঘটনার পর থেকেই বেপাত্তা হয়ে রয়েছেন অভিযুক্ত পঞ্চায়েত সদস্য। আক্রান্তেরা বর্তমানে রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ওই ঘটনায় নয় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশ দুই জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের কাছ থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই, এই নিয়ে সুর চড়াচ্ছে বিজেপি।
রানাঘাট-১ ব্লকের অধীনে রয়েছে আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতের নন্দীঘাট এলাকায় ৬২ নম্বর বুথের তৃণমূলের বুথ সভাপতি আবির আলি মণ্ডল। জানা গিয়েছে, সোমবার রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ জগপুর রোড ধরে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও দুই তৃণমূল কর্মী মমিন মণ্ডল ও সাদ্দাম মণ্ডল। তাঁরা দু’টি বাইকের তিন জন ছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, আনুলিয়া হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ির পথে যেতেই সারদাপল্লি এলাকায় হঠাৎ পথ আটকায় গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য দেবাশিস কাহার ওরফে দেবা ও তার দলবল। তৃণমূল বুথ সভাপতির কানে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে তাঁকে বাইক থেকে নামানো হয় বলে অভিযোগ। এর পরে কেন তাঁর পথ আটকানো হচ্ছে, সে প্রশ্ন করতেই বুথ সভাপতিকে পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয় বলে অভিযোগ। বুথ সভাপতি সঙ্গে থাকা তৃণমূলের দুই কর্মী বাধা দিতে গেলে তাঁদেরকেও রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। রাতেই রক্তাক্ত ও জখম অবস্থায় তিন জনকে রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আবির যে বুথের সভাপতি, সেই বুথে লোকসভা ও বিধানসভা উপনির্বাচনে আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্য বুথের তুলনায় সব চেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে লিড হয়েছে তৃণমূলের। অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে দলীয় সংগঠনে আবিরের উত্থানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি দলেরই অপর গোষ্ঠী। যে কারণে এই হামলার ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে আক্রান্ত বুথ সভাপতি আবির আলি মণ্ডল বলেন, ‘‘দলেরই পঞ্চায়েত সদস্য ক’জন দুষ্কৃতীকে নিয়ে রাতে আমাদের উপরে হামলা করে। এর আগেও আমায় প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। লোকসভা নির্বাচন এবং সম্প্রতি হওয়া রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা উপনির্বাচনে আমি আমার বুথ থেকে দলকে সব চেয়ে বেশি ভোটে লিড দিয়েছি। তাতেই আমার উপরে আক্রোশ।’’
বুথ সভাপতির আরও অভিযোগ, ‘‘হামলার ঘটনার সময়ে নিজে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতী রানাঘাট শহরের বাসিন্দা টিঙ্কু সুতার।’’
কে এই টিঙ্কু সুতার? গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর আনুলিয়ায় একাধিক বিজেপি নেতা, কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর, মারধর ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময়েও টিঙ্কু ও তার দলবলের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনার অভিযোগ ওঠে। তৃণমূলে কোনও পদে না থেকেও সম্প্রতি আনুলিয়া অঞ্চলের ‘ত্রাস’ হয়ে উঠেছে টিঙ্কু। এমনকি, রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা উপনির্বাচন উপলক্ষে রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে হওয়া বৈঠকেও বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে হাজির থাকতে দেখা গিয়েছে টিঙ্কুকে। তৃণমূলের একাংশের দাবি, সম্প্রতি টিঙ্কুকে নিয়ে দলে মতানৈক্য তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ে তার হিংসাত্মক কার্যকলাপের কারণে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দলকে।
মঙ্গলবার আক্রান্ত তিন তৃণমূল কর্মীকে হাসপাতালে দেখতে আসেন রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক তাপসকুমার ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘কোনও ভাবে এই ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। বিষয়টি দলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। প্রশাসন তদন্ত করছে। দলীয় ভাবেও তদন্ত করা হবে।’’
ঘটনার পর থেকেই বেপাত্তা অভিযুক্ত তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য দেবাশিস। মঙ্গলবার পঞ্চায়েত অফিস ও বিণ পাড়ার বাড়িতে গিয়েও তার দেখা মেলেনি। অন্য দিকে, আর এক অভিযুক্ত টিঙ্কুর খোঁজে এ দিন সকাল থেকে অতিরিক্ত পুলিশ জেলা সুপার (রানাঘাট মহকুমা) লাল্টু হালদারের নেতৃত্বে শহরের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়। রানাঘাট কলেজের বিপরীতে থাকা টিঙ্কুর একটি রেস্তরাঁতেও এ দিন তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে। একটি আগ্নেয়াস্ত্র-সহ সোমবার রাতেই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের নাম রবি হালদার ও ঋতম চক্রবর্তী। তাদের বাড়ি আনুলিয়ায়।
অন্য দিকে, তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামনে আসতেই রাজনৈতিক ভাবে সুর চরিয়েছে বিজেপি। নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা বিজেপির মুখপাত্র সোমনাথ কর বলেন, ‘‘আসলে এটা ক্ষমতার লড়াই। তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে তৃণমূলই। বাংলায় আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। পুলিশ সব জেনেও এখন লোক দেখাতে রেস্তরাঁয় তালা ঝোলাচ্ছে, তল্লাশি চালাচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy