কৃষ্ণগঞ্জ থানায় বিজেপির বিক্ষোভ। নিজস্ব চিত্র
দোতলার বারান্দা থেকে আঙুল উঁচু করে সামনের মাঠটার দিকে দেখাচ্ছিলেন এক শিক্ষিকা। সোমবার যে মাঠে লাঠি হাতে ছুটে বেড়াচ্ছিল উন্মত্ত যুবকের দল। বোমা পড়েছিল। রণাঙ্গনের চেহারা নিয়েছিল ওই মাঠ এবং তাকে ঘিরে থাকা কলেজ চত্বর। আহত বিজেপি সমর্থক প্রদীপ কুণ্ডুকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ জানিয়েছে তাঁর পরিবার। যদিও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।
এবং মাজদিয়ার সুধীরঞ্জন লাহিড়ী কলেজ এখনও পুরোপুরি ধাতস্থও হতে পারেনি। পুলিশকে কার্যত দাঁড় করিয়ে রেখে টিএমসিপি এবং এবিভিপি-র সমর্থকেরা যে ভাবে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ছুড়েছে, গুলি ছোড়া হয়েছে শূন্যে, সাম্প্রতিক কালে নদিয়া জেলায় তার নজির প্রায় নেই। টিএমসিপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও পাল্টা আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, তার নজিরও বেশি নেই।
এখনও কলেজের মাঠে-রাস্তায় ইতিউতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বোমার সুতলি। পোড়া দাগ। সে দিকে দেখিয়ে শিক্ষিকা বলেন, “প্রায় দশ বছর হল, এই কলেজে পড়াচ্ছি। ছাত্রদের মধ্যে অনেক গন্ডগোল দেখেছি। কিন্তু এমন কোনও দিন দেখিনি।” পাশ থেকে এক মাঝবয়সি এক শিক্ষক বলেন, “যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না এখনও। এত বোমা কোথায় ছিল? গুলির শব্দও শুনতে পেয়েছি!”
ছাত্র সংঘর্ষের কারণে মাজদিয়া কলেজ বারবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনাও ঘটেছে একাধিক বার। কিন্তু এমন যথেচ্ছ গুলি-বোমা চলার কথা মনে করতে পারছেন না এলাকার কেউই। এখনও সকলের চোখে-মুখে আতঙ্কের রেশ। সকাল থেকেই কলেজ চত্বর থমথমে। এ দিন প্রথম ও তৃতীয় সেমেস্টার ছিল। ছাত্রছাত্রীরা কোনও রকমে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানান, সোমবারের গোলমালের জেরে অনেকেই পরীক্ষা দিতে আসেননি। পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল টেনেটুনে ৭৫ শতাংশ। যদিও শিক্ষকদের একাংশের দাবি, তা আদৌ ৬০ শতাংশের বেশি হবে না। আসেননি কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাও। তাঁরাও আতঙ্কিত।
কয়েক মাস আগেও যেখানে শুধু টিএমসিপি-র ঝান্ডা উড়ত, সেখানে গোটা কলেজ চত্বরে কোথাও তাদের সামান্য চিহ্নটুকুও এ দিন দেখা গেল না। চারদিকে শুধু এবিভিপির পতাকা আর ফ্লেক্স। কলেজে বয়েজ় ক্যান্টিনের সামনে তখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ারের টুকরো-টাকরা। ক্যান্টিনে হাতে গোনা কয়েক জন যুবক, যাঁরা নিজেদের পড়ুয়া এবং এবিভিপি সমর্থক বলে পরিচয় দেন।
সকালে গেট খোলার পরে বেশ কয়েক জন এবিভিপি নেতাকর্মী হাজির হয়েছিলেন। তাঁরাই দিনভর কলেজ চত্বরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এঁরা তাঁদেরই অন্যতম। কলেজের ধারে-কাছেও দেখা মেলেনি টিএমসিপি-র কারও। ক্যান্টিনে বসা এবিভিপি সমর্থকেরা দাবি করেন, “কলেজের ভিতরে কেউ এবিভিপি ছাড়া কিছু করে না। টিএমসিপি বলে কিছু নেই। কাল যারা কলেজে ঢুকেছিল, তারা তো বাইরের সমাজবিরোধী।”
গোলমালের পরেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। এ দিন বিকেলে তারা কৃষ্ণগঞ্জ থানায় স্মারকলিপি দেয়। কৃষ্ণগঞ্জের বিজেপি বিধায়ক আশিস বিশ্বাস এবং দলের নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি মানবেন্দ্রনাথ রায়ও উপস্থিত ছিলেন। দলীয় সমর্থক প্রদীপ কুণ্ডুকে মারধরে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি তোলা হয় বিজেপির তরফে। যাওয়ার আগে কার্যত হুমকির সুরেই মানবেন্দ্র বলে যান, “২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেউ গ্রেফতার না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।” বারবার ফোন করা হলেও কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার জাফর আজমল কিদোয়াই তা ধরেননি।
কলেজের অধ্যক্ষ সরোজেন্দ্রনাথ কর বলেন, “প্রথম থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, যাই হয়ে যাক না কেন কলেজ আমরা খোলা রাখবই। তবে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিতে আসেনি। হয়তো কালকের ঘটনার পরে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আশা করছি, দ্রুত কলেজের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে।”
পরীক্ষার পরে বিকেলে তাড়াহুড়ো করে কলেজ থেকে বেরোচ্ছিলেন চার ছাত্রী। গত দিনের গন্ডগোলের প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁরা আরও জোরে পা চালিয়ে দিলেন। কোনও কথাই বলতে বা শুনতে তাঁরা রাজি নন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ছাত্র শুধু বলেন, “বাবা বলেছেন, এমন চলতে থাকলে আর কলেজে আসার সরকার নেই। শুধু পরীক্ষার সময়ে এলেই হবে। জানি না, আগামী দিনে কি হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy