Advertisement
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

চোরা শ্রাবণে সিঁধ গিয়েছে চুরি

ঘর় অন্ধকার। যত অন্ধকার, তত এরা ভাল দেখে; চোখ জ্বলে মেনি বিড়ালের মতো, সময়বিশেষে বন্য বাঘের মতো। মেয়েটা কালো কি ফর্সা দেখা যায় না, কিন্তু ভরভরন্ত যৌবন। ... বাঁ-হাতটা আদর বুলাচ্ছে, ডান হাতের ক্ষিপ্র আঙুলগুলো ইতিমধ্যে নেকলেশ, চন্দ্রহার, কঙ্কণ একটা একটা করে খুলে সরিয়ে নিল। গা খালি হয়ে গেল— কিছুই টের পায় না মেয়ে, আবেশে চোখ বুজে আছে। হাতের এমনিধারা মিহি কাজ।... আজকাল ওসব নেই, কষ্ট করে কেউ কিছু শিখতে চায় না। নজর খাটো— সামনের মাথায় যা পেল কুড়িয়ে বাড়িয়ে অবসর। কাজেরও তাই ইজ্জত থাকে না— বলে, চুরি-ছ্যাঁচড়ামি। সেকালে ছিল— চোর মানেই চতুর, চুরি হল চাতুরী। চুরিবিদ্যা বড়বিদ্যা— বড় নাম এমনি হয়নি। অতিশয় কঠিন বিদ্যা। এ লাইনে দিকপাল হতে হলে ওস্তাদের কাছে রীতিমত পাঠ নিতে হত।... চোরের নামে পাড়াপ্রতিবেশী এসে জুটছে। সিঁধের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কেউ কেউ। বড় বাহারের সিঁধ গো! জানলার গরাটের নিচে মাটির দেয়াল আধখানা চাঁদের মতো কেটেছে। কেটেছে যেন কম্পাস ধরে, একচুলের এদিক-ওদিক নেই। হাত কত চোস্ত হলে তাড়াতাড়ির মধ্যে এমন নিখুঁত গর্ত হয়। ...জাত কারিগরের কাজ। মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’ থেকে (মূল বানান অপরিবর্তিত)ঘর় অন্ধকার। যত অন্ধকার, তত এরা ভাল দেখে; চোখ জ্বলে মেনি বিড়ালের মতো, সময়বিশেষে বন্য বাঘের মতো। মেয়েটা কালো কি ফর্সা দেখা যায় না, কিন্তু ভরভরন্ত যৌবন।

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

কল্লোল প্রামাণিক ও সুজাউদ্দিন
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৬ ০২:৩২
Share: Save:

চোরেদের শ্রাবণ মাস, গৃহস্থের সর্বনাশ!

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। চারপাশ সুনসান। বৃষ্টির চড়বড় শব্দে চাপা পড়ে যায় অন্য সব আওয়াজ। এর মধ্যেই চুপিসারে যে হাতের কাজ সেরে ফেলতে পারে না, সে কেমন তস্কর!

নদিয়ার মেঘনা সীমান্তের শ্রীনিবাস মণ্ডলের (নাম পরিবর্তিত) চোখ দু’টো যেন দপ করে জ্বলে উঠল, ‘‘থাকত মাটির ঘর! দেখিয়ে দিতাম চুরি কাকে বলে। মাখনের মতো সরিয়ে দিতাম গোটা গেরস্থালি। কেউ কিস্যু টের পেত না।’’

পরক্ষণেই ঝিমিয়ে পড়ছেন। গলাতেও কিঞ্চিৎ বিষণ্ণতা, ‘‘সেই মাটির ঘরও নেই, সিঁধও নেই। কারবারটাই তো শিকেয় উঠল। পরে পাকাবাড়িতে যে চেষ্টা করিনি, তা নয়। কিন্তু ওই পেল্লাই পাঁচিল টপকানো কি সোজা কথা!’’

এই প্রজন্মের ছেলে-ছোকরারা শ্রীনিবাসকে নিয়ে এখন মস্করা করে বটে। তবে পুরনো আমলের লোকজনদের আজও মনে আছে শ্রীনিবাসের হাতের কাজ। হোগলবেড়িয়ার সমর বিশ্বাস যেমন বলেন, ‘‘মনে আবার থাকবে না! সিঁধের শ্রী দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম এ কাজ শ্রীনিবাসের। কিন্তু প্রমাণ কোথায়?’’ ফলে গোটা বর্ষা জুড়ে আমরাও সতর্ক থাকতাম। তক্কে তক্কে থাকত শ্রীনিবাস ও তার শিষ্যরা। সমরবাবুর গলায় আফশোস, ‘‘তবে কি জানেন, শেষতক জয় হত ওদেরই।’’

আবার অন্য ছবিও আছে। বৃষ্টি ধরে এসেছে। আকাশে ফালি চাঁদ। এক এক করে নিভে গেল ডোমকলের মোল্লাবাড়ির হ্যারিকেনগুলোও। আর বিলম্ব নয়। চুপিসারে জহির শেখ (নাম পরিবর্তিত) এগিয়ে গেলেন। পিছনে সঙ্গীরা। নিপুণ ভাবে কেটে ফেলা হল সিঁদ। এ বার মাথা গলাতেই পারলেই কেল্লা ফতে।

কিন্তু এ কী! ভিতরে মাথাটা পুরোটা গিয়েছে কি যায়নি, খামচে চুল ধরল কে? কে নয়, কারা? সেইসঙ্গে মহিলাদের সমস্বরে চিৎকার, আর মুড়ো ঝাঁটার বাড়ি। সেই সঙ্গে পিছন থেকে এসে কারা যেন টেনে ধরল পা। সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা! সঙ্গীরা তো আগেই ধাঁ। জহির ধরা পড়ে গেল।

তারপর গাছে বেঁধে উত্তম মধ্যম, সালিশি, মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে তবেই নিস্তার মিলেছিল। নাহ, সে যাত্রা আর থানা-পুলিশ করেননি মোল্লাবাড়ির লোকেরা।

বছর বিশ-ত্রিশ আগে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ সীমান্তে চুরি-ডাকাতি ছিল প্রায় নিত্য ঘটনা। তবে সিঁধেল চোরের উপদ্রব চরমে উঠেছিল। ইলেকট্রিক নেই। রাস্তাঘাট কাঁচা। আষাঢ়-শ্রাবণে সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে তেমন কেউ বেরোতেন না। অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ-র ডাকে সে এক গা ছমছমে পরিবেশ। এমন রাতেই মাটির দেওয়ালে কোপ মারতেন সেই তস্কর শিরোমণিরা।

শ্রীনিবাসের এখন বয়স হয়েছে। টুকিটাকি খেতের কাজ করেন। তাঁর আজও মনে আছে সেই বর্ষা রাতের কথা— পাশের গ্রামে সদ্য বিয়ে হয়েছে বিশ্বাসবাবুর ছোট ছেলের। পাত্রী বনেদি বাড়ি। খুব ধুমধাম হয়েছিল। বিয়ের দিন নতুন বউয়ের গলার হার দেখে চোখ ফেরাতে পারেননি শ্রীনিবাস। তারপর ছিল সময়ের অপেক্ষা। দিনকয়েক পরেই এল সেই সুযোগ। ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বিশ্বাস বাড়ি। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে নিপুণ হাতে শ্রীনিবাস খুলে এনেছিলেন সেই সোনার হার।

তার পরের ঘটনা কিন্তু আরও মারাত্মক। হার চুরি যাওয়ার পরে নতুন বউয়ের সে তো পাগলের মত অবস্থা। খাওয়া-ঘুম সব উধাও। দিনরাত শুধু কেঁদেই চলেছে মেয়েটা। শ্রীনিবাস বলছেন, ‘‘মেয়েটাকে দেখে বড় মায়া হয়েছিল, জানেন। কয়েকদিন পরে জানালা গলিয়ে হারটা আবার ফেরত দিয়ে এসেছিলুম।’’ জলঙ্গির হাসিবুর শেখ যেমন বলছেন, ‘‘সে এক দিন ছিল মশাই। চোরেদেরও মায়া দয়া ছিল। ছিল সহবত।’’

তিনি জানান, গোয়ালের গরু থেকে সিন্দুকের কাঁসার থালা—চুরির তালিকায় ছিল না, এমন জিনিস নেই। ডোমকলের জহির বলছেন, ‘‘তখন সীমান্তে কাঁটার ছিল না। এ দেশে তো বটেই, বাংলাদেশেও যে কতবার সিঁদ কাটার জন্য ভাড়া খেটেছি, তার ইয়ত্তা নেই। দাপটের সঙ্গে কাজ করতাম। এখন তো আর আমাদের দিন নেই!’’

তা হয়তো নেই। কিন্তু চোরেরা তখনও ছিল। এখনও আছে। শুধু বদলে গিয়েছে কেরামতি। এখন সিঁধ কাটার চল নেই। কিন্তু বর্ষা-রাতে পাঁচিল টপকে যায় লিকলিকে শরীর। উঠোন থেকে হাওয়া হয়ে যায় বালতি, কলসি, হাঁড়ি থেকে শুরু করে বাসনপত্র, ভিজে জামাকাপড়। পুলিশও কবুল করছে, বর্ষাকালে ছোটখাটো চুরির ঘটনা কিছুটা হলেও বেড়ে যায়। সেই কারণে এইসময় পুলিশি টহলদারিও বাড়ানো হয়।

তবে সব ক্ষেত্রে যে অভিযোগ হয়, এমনটাও নয়। এক গৃহস্থের কথায়, “ক্ষতিটা ক্ষতিই। কিন্তু সামান্য দু’টি কাপড় বা কলসি চুরির কথা বলতে থানা-পুলিশ করতে কেউ চান না।

জেলা পুলিশের এক আধিকারিক যেমন বলছেন, ‘‘সিঁধ কেটে চুরি এখন আর হয় না। তাই বলে চুরি কিন্তু বন্ধ হয়নি। তার রকম বদলেছে। ইদানীং আমরা লক্ষ করছি, বেশিরভাগ ছিঁচকে চোর মানেই মাদকাসক্ত। মাদক কেনার টাকার জন্য সাইকেল, মোবাইল যা পায়!’’

তা নিক, সিঁধেল তো নয়, যে আস্ত বাড়িটাই ফাঁকা করে দেবে!

তবে, গ্রামের প্রবীণদের মাঝে মধ্যে মন খারাপও উথলে ওঠে। ডোমকলের এহতেসাম আলম যেন বলছেন, ‘‘বিদ্যুৎ এল, রাস্তা পাকা হল, ঘরবাড়িও। তবে সেই সব শীত-বর্যার রাতের মতোই সিঁধেলরাও হারিয়ে গেল জানেন!’’

অন্য বিষয়গুলি:

brick house Sidhel thief mud house
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy