মাথাভাঙার ও পারে বাংলাদেশ, এ পারে যত্রতত্র চলে শবদাহ। করিমপুরে। নিজস্ব চিত্র।
ও প্রান্তে বাংলাদেশ। এ প্রান্তে ভারত। মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে পদ্মা, কোথাও বা মাথাভাঙা নদী। নদিয়ার হোগলবেড়িয়া সীমান্তের এই দুই নদীর তীরে বেশ কয়েক জায়গায় মৃতদেহ দাহ করার প্রথা দীর্ঘ দিন ধরেই চলে আসছে।
কিন্তু কার মৃতদেহ পোড়ানো হল, কারা পোড়াতে আনলেন, সে সব কোনও তথ্যই থাকে না স্থানীয় পঞ্চায়েতের হাতে। এমনই অভিযোগ উঠে আসছে নদিয়ায় ধর্ষিতা নাবালিকা মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, দাহ কাজে বৈধ কাগজপত্রের কোনও বালাই নেই। কখনও কখনও মৃতদেহ দাহ করার বেশ কয়েক দিন পার হয়ে যাওয়ার পর পঞ্চায়েত থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র নেওয়ার জন্য উদ্যোগ শুরু হয়। আশপাশের চিকিৎসক ধরে মোটা টাকার বিনিময়ে ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়া হয়। সেই চিকিৎসকের লেখা ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিলেই মিলে যায় পঞ্চায়েতের মৃত্যু-শংসাপত্র।
কাছারিপাড়া বাসিন্দা রাখাল মণ্ডল জানাচ্ছেন, গ্রামে কেউ মারা গেলে আশেপাশের লোকজনকে ডেকে, কাঠ জোগাড় করে পদ্মার তীরে নিয়ে গিয়ে মৃতদেহ দাহ করা হয়। তিনি বলেন, ‘‘কাগজপত্র আমরা পরে জোগাড় করি।’’
প্রশ্ন উঠছে, যদি সীমান্ত এলাকায় কোনও দুষ্কৃতী কোনও অপরাধ ঘটিয়ে দেহ দাহ করে ফেলে কিংবা কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় কেউ গোপনে মৃতদেহ দাহ করে চলে যায়, সে ক্ষেত্রে প্রশাসনিক স্থিতাবস্থার কী নিশ্চয়তা থাকছে?
গ্রামবাসী বিশ্বনাথ মণ্ডল এর জবাবে বলেন, ‘‘গ্রামের কেউ মারা গেলে পাঁচ জন মানুষ ডেকেই দেহ পোড়ানো হয়। তবে মাঝেমধ্যে রাতের দিকে কে বা কারা মৃতদেহ নিয়ে এসে পুড়িয়ে ফেলছে, আমরা বুঝতে পারি না। সেখানেই আমাদের ভয়।’’
তাঁর আরও বক্তব্য— ‘‘সেটা দেখা তো গ্রামের মানুষের কাজ নয়। এসব পঞ্চায়েত-প্রশাসন দেখবে।’’
এই প্রসঙ্গে স্থানীয় সিপিএম পঞ্চায়েত সদস্য শঙ্কর মণ্ডল জানান, দিনের বেলায় দাহকার্যে বিএসএফ কিছুটা ছাড় দিলেও রাতে হঠাৎ করে মৃতদেহ দাহ করতে গেলে তারা বাধা দেয়। তিনি বলেন, ‘‘শ্মশানযাত্রীদের বিএসএফই পঞ্চায়েত সদস্যদের ডাকতে বলে। তখন আমার ডাক পড়ে। তবে এই শ্মশানে কোনও কাগজপত্র লাগে না। গ্রামের কোনও মানুষের কী ভাবে মৃত্যু হল, সেটা দেখে নিয়ে দেহ দাহ করার জন্য সহযোগিতা করি।’’
এ ক্ষেত্রে কাগজপত্র ছাড়াই যদি দাহ-কাজ হয়ে যায়, তা হলে পঞ্চায়েত থেকে মৃত্যু শংসাপত্র মিলছে কী করে?
এই বিষয়ে শঙ্করের জবাব, ‘‘গ্রামে কারও মৃত্যু হলে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড-সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পঞ্চায়েতে জমা দেওয়ার পর মৃত্যু সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার কাছে প্রায়ই খবর আসে যে, মৃতদেহ দাহ করার প্রায় সাত-আট দিন পর কোনও ডাক্তারবাবু পাঁচশো-সাতশো টাকার বিনিময়ে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। এ ভাবেই তো চলছে।’’
এর কারণ হিসাবে তিনি ব্যাখ্যা করে জানান, গ্রামে কেউ মারা গেলে, নিয়ম মেনে ডাক্তারি সার্টিফিকেট জোগাড় করতে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার দূরে করিমপুর হাসপাতালে মৃতদেহ নিয়ে যেতে হবে। বাড়তি ঝামেলা ও খরচ বাঁচাতে তাই গ্রামের মানুষ কাগজপত্র ছাড়াই নদীতীরে মৃতদেহ করে ফেলেন।
সীমান্ত-লাগোয়া মধুগাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সোমা মণ্ডল বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আসলে এই ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। তবে মৃত্যু-শংসাপত্র দেওয়ার আগে আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে থাকি।’’
একইসঙ্গে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী দিনে বিতর্ক এড়াতে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দাহ করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘‘আমি পুলিশ ও বিএসএফের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।’’
মধুগাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের পাশেই হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েতের সীমান্ত বরাবর চলে গিয়েছে মাথাভাঙা নদী। নদী বরাবর চরমেঘনা, বালিয়াশিশা, নাসিরের পাড়া-সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। গ্রামের মানুষ মাথাভাঙা নদীর পাশে দীর্ঘ দিন ধরেই মৃতদেহ দাহ করছেন। এর কোনওটিই পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রনে নেই, এমনটাই জানাচ্ছেন স্থানীয়েরা।
কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় যদি নির্জন জায়গায় দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়, তবে তার দায় কে নেবে? এই প্রশ্নের উত্তরে হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান প্রকাশচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘মানছি, বিষয়টি উদ্বেগের। তবে এ ভাবেই চলে আসছে।’’
উল্টে তাঁর প্রশ্ন— ‘‘গ্রামের মানুষ চটজলদি ডাক্তারের কাছ থেকে মৃতদেহের ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করবেন কোথা থেকে?’’ পরে অবশ্য পঞ্চায়েত প্রধান বলেন, ‘‘ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি। আর বেনিয়ম চলতে দেওয়া যাবে না।’’
এই প্রসঙ্গে বিএসএফের এক আধিকারিক জানান, মৃতদেহ দাহ করতে এলে তাঁরা সচিত্র পরিচয়পত্র যাচাই করে নেন। তাঁর কথায়, ‘‘মৃত্যু স্বাভাবিক, না অস্বাভাবিক— তা দেখা আমাদের কাজ নয়। সেটা দেখবে পঞ্চায়েত ও পুলিশ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy