Advertisement
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus

ওড়না সম্বল, করোনা গুহায় ঘুরছেন ওঁরা

চাপড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ডোমপুকুরে বাড়ি নাজমা বিবির। ডোমপুকুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেকেন্ড এএনএম তিনি। নিজের গ্রাম ছাড়াও তাঁকে পাশের ছোট আন্দুলিয়া গ্রামও দেখতে হয়।

জটলা দেখে তেড়ে যাচ্ছেন নাজমা বিবি। চাপড়ায়। নিজস্ব চিত্র

জটলা দেখে তেড়ে যাচ্ছেন নাজমা বিবি। চাপড়ায়। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০ ০৫:১৮
Share: Save:

রোজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ওড়নাটা ভাল করে মুখে জড়িয়ে নেন বছর পঞ্চাশের নাজমা বিবি। লকডাউন বলে তাঁর তো আর ঘরে বসে থাকলে চলবে না। তাঁকে ঘুরতে হবে গ্রামে। পাড়ায়-পাড়ায় গিয়ে কথা বলতে হবে জেলার বাইরে থেকে ফেরা মানুষগুলোর সঙ্গে। তাঁদের বোঝাতে হবে ‘হোম কোয়রান্টিন’ কী। ঢুকিয়ে দিতে হবে ঘরে। খোঁজ নিতে হবে স্বাস্থ্যের।

চাপড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ডোমপুকুরে বাড়ি নাজমা বিবির। ডোমপুকুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেকেন্ড এএনএম তিনি। নিজের গ্রাম ছাড়াও তাঁকে পাশের ছোট আন্দুলিয়া গ্রামও দেখতে হয়। দুই গ্রাম মিলিয়ে আট জন আশাকর্মী তাঁর অধীনে কাজ করেন। তাঁদের অবস্থাও নাজমার মতোই— মাস্ক নেই, ওড়না সম্বল। যা ভাইরাস তো নয়ই, চৈত্রের ধুলোও ঠিক মতো আটকাতে পারে না। একেবারে প্রথম দিকে তাঁদের দুটো করে সার্জিকাল মাস্ক দেওয়া হয়েছিল, যা এক বারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। সেটাই তাঁরা বারবার ব্যবহার করছেন। ছিঁড়ে যাওয়ার পর কেউ-কেউ চাপড়া বাজার থেকে ৩০ টাকা দিয়ে গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক কিনে এনেছিলেন। তা-ও ছিঁড়ে গিয়েছে। স্যানিটাইজ়ারও নেই। কার্যত অরক্ষিত অবস্থাতেই তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাড়ি-বাড়ি। কোথায় বিপদ ওত পেতে রয়েছে, কারও জানা নেই। নাজমা বলেন, “কিছু করার নেই। এই অবস্থাতেই আমাদের কাজ করতে হবে। না হলে রক্ষে নেই।”

গ্রামে কাজ করা এমনিতেই কঠিন। বাইরে থেকে ফেরা লোকগুলো কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না। কিছু বলতে গেলে উল্টে মেজাজ শুনতে হয়। প্রথম দিকে তো মারমুখিও হয়ে উঠছিল অনেকে। কিন্তু এএনএম এবং আশাকর্মীরা পিছিয়ে যাননি। কারণ গ্রামাঞ্চলে তাঁরাই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিত। তাঁরাই বাড়ি-বাড়ি ঘুরে তৈরি করেছেন ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা। হোম কোয়রান্টিনে থাকা লোকেদের বাড়ির দেওয়ালে নোটিস সাঁটা থেকে শুরু করে প্রতিবেশীদের সচেতন করার মতো যাবতীয় কাজ তাঁদেরই করতে হয়। ডোমপুকুরের আশাকর্মী হাদিসা বেগমের দায়িত্বে আছে ২৬০টি পরিবার। তার মধ্যে ৪২ জন আছেন যাঁরা ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরেছেন। তিনি বলেন, “বাড়িতে দুটো মেয়ে আছে আমার। চিন্তাটা ওদের জন্যই বেশি হয়। মাঝে মাঝে ভয় হয়। কিন্তু কাজটা তো করতে হবে।”

তেহট্টের ভিটারপাড়ার আশাকর্মী নুরজাহান মল্লিক নিজেই গেঞ্জি কেটে মাস্ক বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “এ ছাড়া তো কিছু করার নেই। সরকার থেকে তিনটে দিয়েছিল। সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে নিজেই একটা বানিয়ে নিলাম। কারণ কাজটা তো করতে হবে।” বার্নিয়ায় দিল্লি সংযোগে পাঁচ জনের করোনা ধরা পড়ার পরে ভয় যেন তাঁদের আরও চেপে ধরতে চাইছে। নাম-কা-ওয়াস্তে মাস্ক না হয় বানিয়ে নিলেন নিজের মত করে। কিন্তু স্যানিটাইজার? সরকার দেয়নি। তাই ছোট সাবান সঙ্গে নিয়ে বেরচ্ছেন তাঁরা। এক বার কোনও বাড়িতে ঢুকলে সেখান থেকে বেরিয়েই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছেন।

চাপড়া, বা তেহট্টের মতো করিমপুরেও প্রচুর মানুষ বাইরে থেকে ফিরেছেন। শুধু করিমপুর ১ ব্লকেই সংখ্যাটা প্রায় ১৭শোর মতো। এই ব্লকে ২৭টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। সেখানে কাজ করেন ১৫১ জন আশাকর্মী। যাঁদের সবাইকেই প্রথমে দু’তিনটে করে সার্জিকাল মাস্ক দেওয়া হয়েছিল। ক’টা দিন তাতে চললেও তার পর থেকে বাজার থেকে নিম্নমানের মাস্ক বা ওড়নাই তাঁদের সম্বল। করিমপুর ১ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক মনীষা মণ্ডল বলেন, “জেলা থেকে যা পাঠানো হয়েছিল সেটাই সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আরও মাস্ক চেয়েছি। এলেই তা ফের বিলি করা হবে।”

জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত দেওয়ান বলেন, “আমরা এখনও পর্যন্ত এক লক্ষ ২০ হাজার সার্জিকাল মাস্ক পেয়েছি। সেগুলো আশা, এএনএম এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্কও দেওয়া হবে। যাতে ওঁরা একটা কেচে দিয়ে অন্যটা ব্যবহার করতে পারেন।” জেলা প্রশাসনের ওসি (স্বাস্থ্য) বিশ্বজিৎ ঢ্যাং বলেন, “আমরা রাজ্যের কাছে ৪০ হাজার পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্ক চেয়েছিলাম। মঙ্গলবার পর্যন্ত ২২ হাজার পেয়েছি। বাকিটাও দ্রুত পেয়ে যাব আশা করি।”

সহ প্রতিবেদন: কল্লোল প্রামাণিক ও সাগর হালদার

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy