Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

নির্জন এককের সাধনায় রবীন্দ্রশব্দের সংগ্রাহক তিনি

কথোপকথনের সময়কাল ১৯৭২। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ পুলিনবিহারী সেনের তখন দেশজোড়া খ্যাতি। তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র গ্রন্থপঞ্জি সংকলনের কাজে ব্যস্ত।

বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (বাঁ দিকে), ‘রবীন্দ্র শব্দকোষ’ (ডান দিকে)।

বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (বাঁ দিকে), ‘রবীন্দ্র শব্দকোষ’ (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৩ ০৮:২২
Share: Save:

স্বীকারোক্তি শুনে পুলিনবিহারী সেন বাক্যহারা! “অত টেলিফোন ধরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” দ্বিধাহীন কণ্ঠে জানালেন বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। প্রবীণ পুলিনবিহারীর পাল্টা— “সে কথা আমাকে বললেই হত।” মধ্যচল্লিশের বীরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন “তা হলে কি আপনি আসতে দিতেন? আমায় মার্জনা করবেন।”

কথোপকথনের সময়কাল ১৯৭২। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ পুলিনবিহারী সেনের তখন দেশজোড়া খ্যাতি। তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র গ্রন্থপঞ্জি সংকলনের কাজে ব্যস্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বারই ‘রবীন্দ্র শব্দকোষ’ গ্রন্থের জন্য ডি লিট পেলেন বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। বহু বছরের নিভৃত, নিরলস গবেষণার ফসল আকর রবীন্দ্রঅভিধান মুগ্ধ করেছিল পুলিনবিহারীকে। তিনি স্বয়ং বীরেন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতেনে নিয়ে যান শিক্ষকতা ও রবীন্দ্র গবেষণার জন্য। অথচ, তিন মাসের মাথায় এক দিন কাউকে কিছু না জানিয়ে একবস্ত্রে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে আসেন বীরেন্দ্রনাথ। স্মৃতি হাতড়ে পুত্র সুমিত্র বিশ্বাস বলেন, “আমি পরে শান্তিনিকেতন গিয়ে পুলিনবিহারী সেন, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে বাবার জিনিসপত্র ফেরত এনেছিলাম।”

প্রবীণ চিকিৎসক সুমিত্র বলেন, “আসলে বাবার রবীন্দ্রচর্চা ছিল নির্জন এককের সাধনা। লোকালয় থেকে বহু দূরে বসে নিজের মতো করে লেখালেখিতে অভ্যস্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেননি। অত লোকজন, ঘন ঘন টেলিফোন এ সব পছন্দ হয়নি। বাবা সে কথা নিজেই বলতেন।”

তেহট্টের প্রত্যন্ত গ্রাম শিবপুরে বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের জন্ম (১৯২৭ -১৯২০)। বাংলায় এম এ পাস করে ১৯৫২ সালে শিবপুরে ফিরে এসে স্থানীয় জনকল্যাণ সঙ্ঘ উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ওই গ্রামে বসেই বীরেন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘রবীন্দ্র শব্দকোষ’। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তাঁর কাজ চমকে দিয়েছিল সে কালের সারস্বত সমাজকে। পেয়েছিলেন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ হিসাবে দেশজোড়া পরিচিতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নদিয়া জেলায় ডি লিট পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি তিনি। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ৬৫০ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ ‘রবীন্দ্র শব্দকোষ’-এর ঋণস্বীকারে লিখেছেন, “রবীন্দ্রশব্দকোষের পরিকল্পনা আমি পেয়েছিলাম আমার অধ্যাপক শ্রীযুক্ত চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর মহাশয়ের কাছে… তাঁর সাহায্য ব্যতিরেকে গ্রামে বসে এই কাজ করা আমার পক্ষে অসাধ্য হত।” বুদ্ধদেব বসু এবং ভবতোষ দত্তের সঙ্গে ‘বহুপ্রসঙ্গের আলোচনা’য় উপকৃত হওয়ার কথাও জানিয়েছেন। মোট ১৫৮ পৃষ্ঠার ভূমিকায় বীরেন্দ্রনাথ সবিস্তারে বলেছেন কেন এই বই। তিনি লিখেছেন— “একান্ত রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত সকল শব্দের বিবৃতি সাধারণ অভিধানে থাকার কথা নয়। কিন্তু সাধারণ অভিধানে স্থান না পেলেও রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত বলে এবং ভাষাতাত্ত্বিক কারণে সেই শব্দের গুরুত্ব আছে। এগুলি একত্র বিধৃত হওয়া উচিত।” এই বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে তিনি লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের শব্দ বলতে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত সমস্ত শব্দ আমার উদ্দিষ্ট নয়। ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ইতিহাস, অর্থ ও গঠনের দিক থেকে উৎসুক্যজনক শব্দই প্রধানত রবীন্দ্রশব্দ বলে আমি অভিহিত করতে চাই।”

রবীন্দ্র শব্দকোষে সংকলিত শব্দগুলিকে বীরেন্দ্রনাথ প্রচলিত, বিরল-প্রচলিত, প্রায়-অপ্রচলিত, অধুনা-অপ্রচলিত এবং নূতন— এই ভাবে ভাগ করেছেন। অভিধানের মতো বর্ণানুক্রমিক ভাবে বিন্যস্ত শব্দগুলি রবীন্দ্রনাথের কোন রচনায়, কী ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও পঙ্‌ক্তিকরণ করেছেন বীরেন্দ্রনাথ।

পুত্র সুমিত্র বলেন, “মনে আছে, বাবা প্রতি দিন রাত তিনটের সময় হ্যারিকেন জ্বালিয়ে লিখতে বসতেন। সকাল ৮টা-৯টা পর্যন্ত লিখতেন। আবার বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে লিখতে বসতেন। রাত ৯টায় আমাদের বাড়ির আলো নিভে যেত। লেখার ঘরে একটা তক্তাপোষের উপর মাদুর বিছিয়ে, বড় বোনকে কোলে নিয়ে বিভিন্ন বই থেকে ছোট ছোট সাদা স্লিপে নোট করছেন— এই ছবি এখনও চোখের সামনে ভাসে। ১৪ বছর ধরে কাজটি করেছিলেন বাবা।”

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy