কারখানায় তালা। অরঙ্গাবাদে তোলা নিজস্ব চিত্র।
আশঙ্কাটা শুরু হয়েছিল প্রথম দিন থেকেই। বড় নোট বাতিলের পরেই প্রমাদ গুনেছিলেন অরঙ্গাবাদ-ধুলিয়ানের বিড়ি কারখানার মালিকরা। সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন বিড়ি শ্রমিকরা। তাঁদের সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে বন্ধই হয়ে গেল এই এলাকার চারটি বিড়ি কারখানা। কাজ হারালেন প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক।
সঙ্কট আরও বাড়বে সোম ও মঙ্গলবার। শনিবারই আরও দুই কারখানা মালিক আগামী দু’দিনে আরও কারখানা বন্ধের কথা ঘোষণা করেছেন। তার ফলে আরও কয়েক হাজার শ্রমিক কর্মচ্যুত হবেন। ধর্মঘট বাদ দিলে স্মরণাতীত কালের মধ্যে এতগুলি বিড়ি কারখানা এক সঙ্গে বন্ধ হয়নি।
শুধু কারখানা বন্ধ হওয়াই তো নয়। আগে কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকরা কোনও রকমে চালিয়ে নিতেন। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে তাঁদের ভাঁড়ার শূণ্য। মালিকদের ভাঁড়াড়েও নোট বাড়ন্ত। সমস্যা মেটার কোনও ইঙ্গিতও মেলেনি। তার ফলে শ্রমিক মহলে ক্ষোভ বাড়ছে।
অরঙ্গাবাদ বিড়ি মালিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাজকুমার জৈন রবিবার জানান, “পুরোনো ৫০০ টাকার নোটে প্রথম সপ্তাহ শ্রমিকদের মজুরি মেটানো হয়েছে। বহু মালিকের ঘরে সে নোটও আর নেই। শ্রমিকরাও সেই বাতিল নোট আর নিতে চাইছেন না।’’ এই অবস্থায় নতুন নোটের জোগান না বাড়লে আগামী সপ্তাহে সমস্ত বিড়ি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে জানাচ্ছেন বিড়ি কারখানা মালিকরা।
কারখানা মালিকদের বিপদ দু’দিক থেকেই আরও জটিল হচ্ছে। ধুলিয়ানের বিড়ি মালিক খলিলুর রহমানও জানাচ্ছেন, একদিকে শ্রমিকদের মজুরি মেটানো যাচ্ছে না. অন্যদিকে খুচরোর অভাবে বিড়ি বিক্রি প্রায় বন্ধ। তাঁর সাফ কথা, ‘‘এইভাবে একের পর এক কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকেরা ভাতে মরবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সরকারকে এটা ভাবতে হবে।
ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০টি বিড়ি কারখানা রয়েছে অরঙ্গাবাদ, ধুলিয়ান ও জঙ্গিপুর মহকুমায়। প্রতিদিন ৪০ কোটি বিড়ি উৎপাদন হয়। প্রায় ৬ লক্ষ শ্রমিক বিড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। শ্রমিকদের মজুরি মেটানো হয় প্রতি সপ্তাহে। তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ।
রাজকুমারবাবু জানান, ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা জানিয়ে দিয়েছে, বিড়ি মালিকদের জন্য আলাদা কোনো ছাড়ের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোনও নির্দেশিকা নেই। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারছেন না বিড়ি কারখানার মালিকেরাও। এই অবস্থায় অনেক কারখানায় এক সপ্তাহের বকেয়া মজুরিও শ্রমিকদের দেওয়া যাচ্ছে না। চারটি বড় বিড়ি কারখানা গত শুক্রবার থেকেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
মাদার ইন্ডিয়া বিড়ি কারখানার ম্যানেজার ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘গত দু’সপ্তাহে উৎপাদিত বিড়ির ৩০ শতাংশও বিক্রি হয়নি। পুরোনো বাতিল নোটে লেনদেন বন্ধ করে দিতে হয়েছে আমাদেরও। তাই গত সপ্তাহ থেকেই কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’’
যে সব বিড়ি শ্রমিকের ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাঁদের অনলাইনে পেমেন্ট করা যায় কিনা, তা নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কারখানা মালিকরা জানাচ্ছেন, অচলাবস্থা না কাটলে, কারখানা খোলা সম্ভব হবে না।
মেঘনা বিড়ি কোম্পানির ম্যানেজার উদয় সাহা জানালেন, “কারখানার সমস্ত গুদামে প্রচুর বিড়ি মজুত রয়েছে। ফলে, হাতে কোনও খুচরো নোট আসছে না। শ্রমিকেরাও ৫০০-১০০০ টাকার পুরোনো নোট নিচ্ছেন না। তাই, বিড়ি শ্রমিকদের শনিবারই জানিয়ে দিয়েছি মঙ্গলবার থেকে আর কাজ হবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। দাস বিড়ি কোম্পানিও জানিয়ে দিয়েছে, সোমবার, অর্থাৎ আজ থেকে কারখানা বন্ধ।
চরম বিপাকে পড়েছেন কাজ হারানো ৬০ হাজার শ্রমিক। তাদেরই একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কাঞ্চন দাস। তিনি বলেন, “বৌমা এবং আমি বিড়ি বেঁধে সংসার চালাই। সাতদিন হয়ে গেল কারখানা বন্ধ। এক সপ্তাহের মজুরি বাকি। পুরোনো নোটও চালাতে পারিনি। এবার যে কী খাব তাই জানি না।’’
রাজ্যের শ্রম দফতরের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন নিজেও বিড়ি কারখানা মালিক। তিনি বলেন, “শুধু ছ’টি নয়, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এখানকার বিড়ি শিল্পই অচল হয়ে যাবে। এর জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলে দুরদর্শিতার অভাব।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘হতভাগ্য শ্রমিকেরা কাজ হারিয়ে কাল থেকে কি খাবে? এ দায় কে নেবে?”
তিনি জানান, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে পরিস্থিতির কথা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের আলোচনায় বসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও এই সঙ্কট নিয়ে কথা বলব।
সিটুর জেলা সভাপতি আবুল হাসনাত খান বলেন, “এই অচলাবস্থা যে আসবে, তা আগেই আশঙ্কা করেছিলাম।” আইএনটিইউসির বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বাদশার আলি বলেন, “একের পর ৬০ হাজার শ্রমিক ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কেন এই বিষয় নিয়ে কোনও কথা বলছেন না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy