ঝুরিভাজার প্যাকেট হাতে পথে রাকেশ। —নিজস্ব চিত্র।
পায়ে ছেঁড়া চটি। পরনে পুরনো হাফ হাতা জামা আর হাফপ্যান্ট। লোহার সরু বেরি ভারী ওজনের কারণে চেপে বসায় নরম হাতের একদিক কিছুটা ফুলে গিয়েছে। কারণ, লোহার শিকের রিংয়ে ঝুলছে ঝুরিভাজার প্যাকেট। শিশুকন্ঠ হেঁকে চলেছে— 'ঝুরিভাজা নেবে... ঝুরিভাজা'। চারপাশের যান্ত্রিক কোলাহলে সেই হাঁক কখনও কখনও হারিয়ে গেলেও অবিচল শিশুকন্ঠ। তবে সে স্কুলে যায়। কিন্তু স্কুল ছুটির পর তৃতীয় শ্রেণির ওই পড়ুয়ার এটাই রোজনামচা। সহপাঠীদের সঙ্গে খেলা-হুল্লোড় করার বয়সে কচি কাঁধে উঠেছে সংসারের বোঝা।
সকাল পৌনে দশটা বাজলেই নীল প্যান্ট, সাদা জামায় স্কুলের পথ ধরে রাকেশ। বছর দশেকের রাকেশ সিকদার। দেড়টায় ছুটির ঘণ্টা বাজলেই গেটপাড়া মাঠপাড়া শিশু শিক্ষাকেন্দ্র থেকে এক দৌড়ে বাড়ি। মা ভাত মেখে তুলে দেন ছেলের মুখে। বেশিরভাগ দিনই জোটে আলু আর ডালসিদ্ধ। পাঁচ বছরের আরাধ্যা ও দু’বছরের প্রিয়াঙ্কা, দুই বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে 'কাজে' বেরিয়ে পড়ে রাকেশ। চূর্ণী নদীর ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পালচৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। কারণ ছুটির পর ওই হাই স্কুলের পড়ুয়ারাই রাকেশের খদ্দের। ক্রমে স্কুলের সামনে ভিড় হালকা হলে ফেরিফান রোড ধরে রানাঘাট শহরের দিকে হাঁটা দেয় রাকেশ। পথে হাঁকতে থাকে 'ঝুরিভাজা নেও না গো'। কেউ কেউ কেনেন। কেউ কেনার বদলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু হাসিমুখে তা ফিরিয়ে দেয় 'পরিণত' শিশুমন। এভাবেই রানাঘাটের গলিপথ ঘুরে ঘুরে ঝুরিভাজা বিক্রি করে চলে রাকেশ।
বাবা মহানন্দ কেরলে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। শেষ কবে বাবা বাড়ি এসেছিল মনে নেই ছেলের। একরত্তি দুই বোনকে সামলাতেই দিন যায় মায়ের। বাবা টাকা পাঠালেও তাতে চারটে পেট চলে না। তাই ঝুরিভাজা নিয়ে পথে নেমেছে এক রত্তি ছেলেটা। কথার ফাঁকে রাকেশ জানায়, ৮০ প্যাকেট ঝুরিভাজা বিক্রি করতেই হবে—এটা ভেবেই বাড়ি থেকে বের হয় সে। যে দিন তা হয়, হাসিমুখে বাড়িতে ফিরেই মায়ের হাতে তুলে দেয় রোজগারের সবটা। আর ছেলের মুখ কালো দেখলে মা বোঝেন 'বিক্রি ভাল হয়নি'। পুজো আসছে। রানাঘাট ছোটবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে 'ছাত্র-হকার'-এর নতুন পোশাক হয়েছে কি না প্রশ্ন করতেই ফ্যাকাসে মুখে উত্তর আসে, "বোনদের নতুন জামা কিনতে পারিনি। তারপর তো আমার!" ৮০ প্যাকেট বিক্রি করলে চারশো টাকা হয়। লাভ থাকে একশো টাকা। লাভ-ভতির হিসাব দিতে গিয়ে রাকেশ বলে, চেষ্টা করি সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরতে। কোনও কোনও দিন রাত হয়ে যায়। পড়াশোনা করতে আমার ভাল লাগে।’’
ছেলে ঘরে ফিরলে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন মা। বোনেরা ঘুমিয়ে পড়লে স্কুলের ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়া শুরু হয় দশ বছরের ‘দশভুজা'র। বইয়ের পাতায় জ্বল জ্বল করতে থাকে রবি-কবিতা—‘আমরা চাষ করি আনন্দে। মাঠে মাঠে বেলা কাটে / সকাল হতে সন্ধে’। পড়তে পড়তে ঘুমে ঢলে পড়তে চায় ক্লান্ত ছোট্ট শরীরটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy