পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীদের ‘টিপ্পনী’ উপেক্ষা করে নিজেদের স্বপ্নে অবিচল সনিয়া আখতার, সতেরা খাতুন, চাঁদতারা খাতুন, আয়েশা খাতুন সুজেরা খাতুনদের মত মুর্শিদাবাদ জেলার উঠতি ক্রিকেটাররা। কেউ অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। কেউ আবার বিএ প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই কিশোরীরা রক্ষণশীল ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসে ২২ গজ মাঠে ব্যাট-বলকে সঙ্গী করে সব কিছুর জবাব দিতে প্রস্তুত।
সিএবি পরিচালিত ‘ডিস্ট্রিক্ট উইমেন্স ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’ আগামী ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। মুর্শিদাবাদ জেলা মহিলা ক্রিকেট দল গড়ার কাজে নেমে পড়েছে মুর্শিদাবাদ জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন। মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ২২ জন কিশোরী ক্রিকেটারদের নিয়ে রবিবার থেকে বহরমপুর স্টেডিয়াম ময়দানে শুরু হয়েছে কোচিং ক্যাম্প। উঠতি ওই ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণের জন্য সিএবি মহিলা প্রশিক্ষক হিসেবে ইলা বিশ্বাসকে বহরমপুরে পাঠিয়েছে। রবিবার ইলা বিশ্বাস বলেন, “কাজটা সহজ নয়। তবে বহরমপুর স্টেডিয়ামের মত বড় মাঠ পাওয়া গিয়েছে বলেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে।”
প্রশিক্ষণ শিবিরে কী শেখানো হচ্ছে? ইলাদেবী বলেন, “কোন বলে কীভাবে ব্যাট চালাতে হবে অথবা বোলিংয়ের রান আপ ঠিক করে দেওয়া, ব্যাটের সামনে বল পড়লে ফ্রন্টফুটে কীভাবে খেলতে হবে, সে ব্যাপারে সড়গড় করে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে ফিল্ডিং সাজানোর বিষয়টিও প্রশিক্ষণের আওতার মধ্যে পড়ে।” তাঁর কথায়, “এমন পরিবারের মেয়েরাও এসেছে, যাঁরা শারীরিক ভাবে সক্ষম নয়। তাঁদের শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কসরত শেখানো হচ্ছে। যেমন কব্জি ও কাঁধের জোর বাড়ানোর উপরে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।”
প্রশিক্ষণ শিবিরে সবচেয়ে বেশি ডোমকল থেকে ১০ জন ক্রিকেটার এসেছে। ডোমকল মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষে আশাবুল মল্লিক ও তৌসিফ আহমেদ ওই ১০ জন ক্রিকেটারকে গাড়িতে করে ৬৫ কিমি পথ পেরিয়ে নিয়ে এসেছেন বহরমপুরে। এলাকার কংগ্রেস বিধায়ক শাওনী সিংহ রায় ওই ক্রিকেটারদের বহরমপুরে নিয়ে আসার জন্য বিনামূল্যে নিজের গাড়ি দিয়েছেন। ডোমকলের ক্রিকেটাররা গাড়িতে এলেও বহরমপুরের প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নেওয়ার জন্য ভগবানগোলার সনিয়া আখতারকে ঘুম থেকে উঠতে হয় সকাল সাড়ে পাঁচটায়। তার পরে বাড়ি থেকে ভগবানগোলা স্টেশন প্রায় পাঁচ কিমি রাস্তা সাইকেলে এসে তার পরে ট্রেন ধরে বহরমপুর স্টেশনে নেমে হেঁটে স্টেডিয়ামে পৌঁছান তিনি। তাঁর কথায়, “আমি ক্রিকেট খেলি পাড়া-প্রতিবেশীরা জানে না। যদি জানতে পারে তাহলে হয়তো খেলতে আসতে বাধা দিতে পারে। তাই জানাইনি।”
সতেরা খাতুন ওরফে টুকু গত তিন বছর ধরে নিয়মিত ক্রিকেট খেলার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বাড়িতে বলার সাহস দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, “আট ভাইবোনের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট। রক্ষণশীল পরিবার বলে আমি বাড়িতে কিছু জানাতে পারিনি। ফলে বাড়ি থেকে কোনও রকম সাহায্য আমি পাই না। বাড়িতে জানতে পারলে খেলা ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে। তবে ক্রিকেট খেলার কথা আমার ভাইপো-ভাইজিরা জানে। কিন্তু পরিবারের লোকজনের কথা ভেবে তারাও বাড়িতে এই নিয়ে কিছু বলে না।”
ডোমকলের জিতপুরের অষ্টম শ্রেণির খুদে ক্রিকেটার চাঁদতারা খাতুন জানায়, “বাড়িতে আপত্তি না করলেও পাড়ার লোকজন বলে‘মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলে কি করবে? তার চেয়ে ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও!’ কিন্তু বাবা ও মা খেলতে আমাকে ভীষণ প্রেরণা দেয়।” ডোমকলের বিলাসপুরের আয়েশা খাতুন রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে পাড়ার লোকজন ‘ওই যে আফ্রিদি আসছে’ বলে টীপ্পনি দেয়। কেন? আয়েশার কথায়, “আমি মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত। তাই পাড়ার লোকজন আফ্রিদির সঙ্গে তুলনা টেনে টিটকিরি দেয়। আমি কোনও উত্তর দিই না। ওই কথার জবাব দিতে আমি ২২ গজকেই বেছে নিই। আমি চাই নিজেকে আফ্রিদির মত ব্যাটসম্যান হতে।” ডোমকলের সুজেরা খাতুনের স্বপ্ন ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
মুর্শিদাবাদ ডিষ্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে তরুণ দত্ত বলেন, “জেলা মহিলা দল গড়ার জন্য বহরমপুর-সহ লাগোয়া বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে চিঠি করা সত্ত্বেও সেই ভাবে সাড়া মেলেনি। গত বছর যেমন কাশীশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিন জন, শিল্পমন্দির থেকে ছ’জন, শ্রীশচন্দ্র থেকে দুজন ছাত্রী এসেছিল। সব মিলিয়ে ২৫ জনকে নিয়ে দল গড়ে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।”
এ বছর চারটি দলে ভাগ করে লিগ ও নক-আউট পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতা হবে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, মালদা নিয়ে ‘এ’ গ্রুপের ম্যাচ জলপাইগুড়িতে, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম ও বর্ধমানকে নিয়ে ‘বি’ গ্রুপের ম্যাচ নদিয়ায়, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া ও হাওড়া একাদশ নিয়ে ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচ দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এবং হুগলি, চন্দননগর, মেদিনীপুর, ক্রিকেট ডেভলপমেন্ট স্কোয়াড নিয়ে ‘ডি’ গ্রুপের ম্যাচ হুগলিতে অনুষ্ঠিত হবে। সেমিফাইনাল থেকে শুরু হবে নক-আউট পদ্ধতিতে খেলা। ওই প্রতিযোগিতার ফাইনালের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে উত্তর দিনাজপুরকে।
ইলাদেবী বলেন, “গত বারের থেকে এ বার আমাদের দল ভাল ফল করবে। গত বার অভিজ্ঞতা ছিল না। ওই ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ও যে ভাবে প্ররিশ্রম করছে মেয়েরা, তাতে ভাল ফলই আশা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy