Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
TMC

জলকামান ছুঁতে পারল না দিলীপকে, ১ ঘণ্টার কর্মসূচি হল ‘রীতি’ মেনেই

উত্তর কলকাতার মিছিলে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেককেই দেখা যায় বড়বাজারের ‘ডন’ গোপাল তিওয়ারির সঙ্গে।

মহাত্মা গাঁধী রোডে বিজেপির মিছিলে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ছবি: দিলীপ ঘোষের টুইটার থেকে

মহাত্মা গাঁধী রোডে বিজেপির মিছিলে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ছবি: দিলীপ ঘোষের টুইটার থেকে

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২০ ১৯:১৫
Share: Save:

সকাল ১১টা:

বিজেপির রাজ্য দফতরের সামনের গলি ছাপিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের ভিড় তখনও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে এসে পৌঁছয়নি। দলের বড় নেতারা তখনও কেউ হাজির হননি রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে। সমর্থকরা মূলত মুরলিধর সেন লেনেই ভিড় করে রয়েছেন। ভিড়ের লেজের দিকটা দলীয় কার্যালয়ের সামনের গলি ছাড়িয়ে আইআইএসডব্লিউবিএম পেরিয়ে হিন্দু হস্টেল পর্যন্ত। গলির সামনেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন বেশ কয়েক জন। বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে। তার মধ্যেই ছিলেন অচিন্ত্য বাউড়ি। লম্বায় টেনেটুনে পাঁচ ফুট। কপালে গেরুয়া ফেট্টি। সবুজ-কালো বড় বড় চেকের জামার অর্ধেক বোতামই খোলা। সমর্থক-বৃত্তের মধ্যে স্লোগানের তালে নেচে চলেছেন।

জলপানের বিরতিতে স্লোগান থামলে হাতে একটা জলের পাউচ নিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে একটা দোকানের ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন অচিন্ত্য। কথা বলতে গিয়ে জানা গেল তাঁর পরিচয়। ঠিকানাও। বুধবার বিকেলেই বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাঁটি থেকে এসেছেন নবান্ন অভিযানে যোগ দিতে।

রাজস্থানে মার্বেল কারখানায় কাজ করতেন অচিন্ত্য। লকডাউনের আগেই বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু তার পর আর ফিরে যেতে পারেননি কাজের জায়গায়। এখন রোজগার বলতে সপ্তাহে মেরেকেটে দু’দিনের দিনমজুরি। অচিন্ত্যের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জলপাইগুড়ির তপন রায়। তিনিও কাজ করতেন কেরলে। দু’জনের এলাকাতেই বিজেপির সাংসদ। ওঁদের দাবি, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। দু’জনের কথাতেই উঠে এল গ্রামীণ স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ। তাঁদের আরও দাবি, লাগামছাড়া দুর্নীতির জন্যই মানুষ আর তৃণমূলকে চায় না। চোখেমুখে দু’জনেরই প্রত্যয় যে, তাঁদের আশা বিফলে যাবে না।

মিছিল শুরু হওয়ার আগে বিজেপি রাজ্য দফতরের সামনে সমর্থকদের ভিড়। ছবি: প্রসেনজিৎ দাস

আরও পড়ুন: ইটবৃষ্টি-বোমাবাজি, উদ্ধার হল পিস্তল, বিজেপির মিছিল ঘিরে ধুন্ধুমার

অচিন্ত্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই, মহাত্মা গাঁধী রোডের দিক থেকে এগিয়ে এল উত্তর কলকাতার একটি বড়় মিছিল। তার পাশাপাশি ছোট-বড় গাড়িতে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়ার মতো কাছের জেলাগুলি থেকে জমায়েত হতে থাকেন সমর্থকরা। উত্তর কলকাতার মিছিলে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেককেই দেখা যায় বড়বাজারের ‘ডন’ গোপাল তিওয়ারির সঙ্গে।

বেলা ১২টা:

কিছু ক্ষণ আগেই পুলিশ ধর্মতলামুখী যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ দলীয় দফতরের সামনের ভিড় এ বার গলি উপচে মূল রাস্তায় এসে পড়েছে। ভিড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে জমায়েতের বিভিন্ন অংশ থেকে উঠে আসা স্লোগানের গর্জন। হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড। ছোট-বড় ঝান্ডা সবার হাতে। সেই ভিড়ের মধ্যেই চোখে পড়ে দলীয় কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করার ধুম। দলীয় কার্যালয়ের সামনের এ দিনের জমায়েতের বড় অংশই ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি।

বেলা সাড়ে ১২টা:

দলের রাজ্য দফতরে এসে পৌঁছলেন দিলীপ ঘোষ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি পৌঁছতেই শুরু হয় মিছিলের তোড়জোড়। দলীয় কর্মীদের মোবাইলে তত ক্ষণে খবর আসতে শুরু করেছে, হেস্টিংস এবং সাঁতরাগাছিতে মিছিল শুরু করতেই পুলিশ তা আটকে দিয়েছে। এ সব নিয়েই শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন। তার পর সকলের যৌথ হুঙ্কার: ‘‘পুলিশ কী ভাবে আটকায় দেখে নেব।”

ব্রাবোর্ন রোডে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের। ছবি: বিজেপির টুইটার থেকে

দুপুর পৌনে ১টা:

বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক অরবিন্দ মেননকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল শুরু করলেন দিলীপ ঘোষ। তাঁদের মিছিল যাওয়ার কথা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে মহাত্মা গাঁধী রোড, সেখান থেকে সোজা বড়বাজারের মধ্যে দিয়ে হাওড়া ব্রিজ (রবীন্দ্র সেতু)। আগে থেকেই যদিও তাঁরা জেনে গিয়েছেন, কলকাতা এবং হাওড়া পুলিশ যৌথ ভাবে মিছিল আটকানোর ব্যাবস্থা করেছে হাওড়া ব্রিজে ওঠার অ্যাপ্রোচ ওয়েতেই।

দিলীপ ঘোষেরা দলীয় কার্যালয় থেকে বেরিয়েই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে ধর্মতলার দিকে হাঁটতে শুরু করেন। যেখান থেকে ‘ইউ টার্ন’ করে তাঁদের মহাত্মা গাঁধী রোডে যাওয়ার কথা, সেই জায়গা ছাড়িয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে মিছিল এগোতেই হুলস্থুল পড়ে যায় পুলিশকর্মীদের মধ্যে। দু’জন অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার এবং ৫ জন ইনস্পেক্টর পড়িমড়ি করে দৌড়তে শুরু করেন মিছিলের সামনের দিকে। দেখে মনে হল ভয় পেয়েছেন, দিলীপ ঘোষ রুট পরিবর্তন করে লালবাজারের দিকে চলে যাচ্ছেন না তো! তবে মেডিক্যলের সামনে পৌঁছেই ‘ইউ টার্ন’ করে পুরনো রুটে ফিরে আসে মিছিল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন পুলিশকর্তারা। কারণ তত ক্ষণে হাওড়া এবং হেস্টিংস কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত।

দুপুর ১টা:

প্রায় আড়াই হাজার সমর্থক-নেতা-কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দিলীপের মিছিল জোরকদমে মহাত্মা গাঁধী রোড ধরে এগিয়ে যায় পোস্তার দিকে। মিছিল সেখানে পৌঁছনোর আগেই সুনসান হয়ে গিয়েছিল বড়বাজার। এমনিতেও করোনা-আতঙ্কে চেনা ভিড় উধাও কলাকাতার সবচেয়ে বড় এই পাইকারি বাজার থেকে। তার উপর অশান্তির আশঙ্কা থেকে পুলিশ আগে থেকেই রাস্তার সমস্ত জটলা, ভিড় ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল মহাত্মা গাঁধী রোড থেকে। সেখান থেকে স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে মিছিলের মাথা ঠিক দেড়টায় পৌঁছে যায় হাওড়া ব্রিজের অ্যাপ্রোচ ওয়েতে।

শর্মিষ্ঠা দাস ঘটক, জগদ্দলের বিজেপি কর্মী। আহত হয়ে সঙ্গীদের খোঁজে হাওড়া ব্রিজের সামনে ছবি: প্রসেনজিৎ দাস

আরও পড়ুন: লাদাখে চিনের ‘একতরফা আগ্রাসন’-এর সব তথ্য ওয়েবসাইট থেকে মুছল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক

দুপুর দেড়টা:

দু’টি স্তরে ব্যারিকেড করে আগে থেকেই হাওড়া ব্রিজের অ্যাপ্রোচ ওয়েতে অপেক্ষা করছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। কলকাতা পুলিশের দুই অতিরিক্ত কমিশনার ছিলেন সেখানকার দায়িত্বে। মিছিল পৌঁছতেই পুলিশ মাইকে ঘোষণা করে জানিয়ে দেয়, ওই জমায়েত বেআইনি। প্রথম ব্যারিকেডে মিছিল পৌঁছে ধাক্কা দেওয়া শুরু করতেই জলকামানের জল আছড়ে পড়ে মিছিলের উপর। জলে ভিজে সামান্য ছত্রভঙ্গ হওয়ার পরেই পুলিশ তেড়ে যায় মিছিলের দিকে। বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকটা ইট-পাথর-বোতল উড়ে আসতে থাকে পুলিশকে লক্ষ্য করে।

পুলিশের লাঠি খেয়ে তত ক্ষণে মিছিলের একটা অংশ ব্রাবোর্ন রোড উড়ালপুলে উঠে গিয়েছে। অন্য অংশ স্ট্র্যান্ড রোড ধরে পিছু হটেছে। তবে পুলিশ তাতে রেহাই দেয়নি। ওই জমায়েতকেও তাড়া করে এলাকা ছাড়া করে তারা।

দুপুর পৌনে দুটো:

ব্যারিকেডের সামনের রাস্তায় তখন পুলিশের লাঠির ঘায়ে ইতিউতি আহত হয়ে পড়ে আছেন কয়েক জন। রয়েছেন দিলীপ ঘোষও। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তাকর্মীদের ঘেরাটোপে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে আহতদের পাশ দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠলেন। তার আগেই ময়দান ছেড়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছেন অরবিন্দ মেনন। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে বিজেপি কর্মীদের ছেঁড়া চটি, জুতো আর জলকামানে ভিজে রাস্তায় বসে সাংবাদিকদের ফোন থেকে বাড়িতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলের কাউগাছি-১ পঞ্চায়েতের সদস্য শর্মিষ্ঠা দাস ঘটক। জলকামানের জলে সর্বাঙ্গ ভিজে সপসপে। পুলিশের লাঠি খেয়ে নড়তে পারছেন না। ফোনটাও হারিয়েছেন। এসেছিলেন যাঁদের সঙ্গে তাঁরা সবাই পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে গিয়েছেন। শেষে কলকাতা পুলিশের এক মহিলা আধিকারিক অধস্তন কর্মীদের নির্দেশ দেন শর্মিষ্ঠাকে দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy