অক্টোবর মাসেই কলকাতায় এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে দেখা করতে। ফাইল চিত্র
সারা ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা যে কোনও দিন ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারণ করতে পারলাম না, তার মুখ্য কৃতিত্ব নবনীতা দেবসেনের। নব্বইয়ের দশকে তিনি আমাদের বিভাগীয় প্রধান, এপিকের ক্লাস নিতেন। প্রথম দিনেই বুঝিয়ে দিতেন, এপিক মানে শুধু রামায়ণ, মহাভারত নয়। মূলত মৌখিক ঐতিহ্যের পরম্পরা বেয়ে ইলিয়াড-ওডিসি থেকে রামায়ণ-মহাভারত, যা কিছু আমাদের কাছে পৌঁছেছে, সেটাই এপিক। এগুলির মধ্যে কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ আছে। রামায়ণের রাম, মহাভারতের ভীম-অর্জুন বা ইলিয়াডের অ্যাকিলিস, সকলেরই জন্ম আধিদৈবিক ভাবে। রামায়ণ, ইলিয়াড-ওডিসি প্রতিটি জায়গাতেই আছে সমুদ্র লঙ্ঘনের চমকপ্রদ বিবরণ। তাঁর শিক্ষকতার কল্যাণে রামচন্দ্রকে আজও এপিকের নায়ক ছাড়া পুরুষোত্তম বা অন্য কিছু ভাবা সম্ভব হয়ে উঠল না। বাঙালির দুর্ভাগ্য, সে নবনীতা দেবসেনকে মূলত রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনির লেখক হিসেবেই চিনল।
এপিক, কামু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলনা নিয়ে ‘কাউন্টারপয়েন্টস’ নামে যে বইতে আলোচনা করেছিলেন, তা এখন দুষ্প্রাপ্য। নবনীতা শুধু অ্যাকিলিস আর রামের তুলনা করে থেমে যাননি। তেলুগু ঐতিহ্যে সীতার দুঃখে ও রামের বিরোধিতায় কী রকম হাসিঠাট্টা, তাও তুলে এনেছেন তাঁর ‘বামাবোধিনী ও কয়েকটি উপন্যাস’-এ। বস্তুত বাংলার মেয়েরাও যে সব সময় রামচন্দ্রের পক্ষে নন, তা নিয়ে মধ্যযুগের চন্দ্রাবতী রামায়ণ ঘেঁটে দেখিয়েছিলেন। তখনও এ শহরে সাইবার সভ্যতা আসেনি। ইংরেজি ভাষায় লেখা সেই নিবন্ধ গড়িয়াহাটের টাইপিস্টদের হাতে টাইপ হয়েছিল, মনে আছে।
নবনীতা তো শুধু ‘আমি অনুপম’-এর মতো উপন্যাস লিখে থামতে চাননি। তিনি ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’ প্রবন্ধ সংকলনের লেখিকা। নবনীতা আসলে সংসারের রোজকার ছোট ছোট ঘটনায় জীবনরস খুঁজে পেতেন। তাঁর দুই মেয়ে, বাড়ির কানাইদাকে নিয়ে যে কত মজার গল্প সাজিয়েছেন, পাঠক-পাঠিকারা জানেন। আমি একবার বেশ বকুনি খেয়েছিলাম। বাঙালি লেখকদের মধ্যে কারা ভাল লেখেন বলতে গিয়ে মহাশ্বেতা দেবী,
প্রতিভা বসু সকলের নাম করেছি। নবনীতাদির বকুনি, ‘‘আশাপূর্ণা দেবীর নাম করবি না? মেয়েদের জীবন যে আপাতদৃষ্টিতে রান্নাঘরে থেকেও আরও বড় জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে, উনিই তার অন্যতম উদাহরণ।’’
এ ভাবে ছোট ছোট কথায় শুধু সাহিত্য নয়, নারীবাদ ও অনেক কিছু নিয়েই তিনি আমাদের চোখ মেলে দেখতে শিখিয়েছেন। যে ভাবে তিনি কৃত্তিবাস যুগের হয়েও তাঁর সমসাময়িক কবিদের মানচিত্র থেকে স্বতন্ত্র, সেটাও মনে রাখতে হবে। তাঁর কৃত্তিবাসী বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতার প্রতি একবার অনুযোগ প্রকাশ করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘বুঝেছিস তো? মেয়েদের সম্পর্কে কী লেখে সে? কবিতা? নাকি কবিতা রচনা করে তাকে? এটাই পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি।’’ নবনীতা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তত্ত্বকথা নয়, হাসতে হাসতে বৈদগ্ধ্যের প্রকাশ ঘটাতেন।
হাসতে হাসতেই তো এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে তিনি অরুণাচল সীমান্তে ম্যাকমাহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। বহু পরে তাওয়াং গোম্ফায় দু’তলা প্রমাণ বুদ্ধমূর্তির আমার ওই ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’ বইয়ের বর্ণনাটা মনে পড়েছিল। তাঁর ভাষায় আমিও বুঝেছিলাম, ‘আজানুলম্বিত’ ও ‘ক্রমশ প্রকাশ্য’ শব্দ দু’টির মানে। তখন বুঝিনি, পরে একাধিক কুম্ভমেলায় রিপোর্টিং করতে গিয়ে বুঝেছি, ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ কাহিনিটির তাৎপর্য। একজন মহিলা হায়দরাবাদের সেমিনার থেকে সটান চলে এলেন কুম্ভমেলায়। সেখানে আশ্রমের তাঁবুতে থেকে ভোররাতে তিনি সঙ্গমের জলে স্নান করতে যাচ্ছেন। ডুব দিচ্ছেন প্রয়াত পিতা ও শ্বশুরমশাইকে স্মরণ করে, হাতে ভাসমান চটি।
নবনীতার নারীবাদ কখনওই উচ্চকণ্ঠ ছিল না। ছোটখাটো অভিজ্ঞতার মাধুর্য বেয়ে তা পাঠকের কাছে পৌঁছে যেত। এই সরসতার আড়ালে ছিল হাসিমুখ এক তেজস্বিতা। অক্সফোর্ডে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছেন নবনীতা। ‘কোথায় পড়াও’ প্রশ্নের উত্তরে নবনীতার জবাব, যাদবপুর। নীরদবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘ওটা একটা ধাপ্পা। কী পড়াও?’’ নবনীতার উত্তর, ‘‘তুলনামূলক সাহিত্য।’’ নীরদবাবুর ফের মন্তব্য, ‘‘ওটা আর একটা ধাপ্পা।’’ নবনীতা শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘আমি ওটা পড়াই তো! ফলে জানি, ওটা ধাপ্পা নয়।’’
এই আলোচনায় সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অক্সফোর্ডবাসী ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। নবনীতা উঠে আসার পরে নীরদবাবুর জিজ্ঞাসা, ‘‘মেয়েটা খুব দজ্জাল, না?’’ তপনবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘‘বিলক্ষণ! সে আর বলতে!’’ নীরদবাবু, তপনবাবু কেউই আজ আর নেই। বাঙালিকে সরস বৈদগ্ধ্যে হাসিয়ে সেই ‘দজ্জাল’ মেয়েটিও চলে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy