Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ভালবাসার স্মৃতি আঁকড়েই রয়ে গেল ‘ভালো-বাসা’

মেয়ে ও তাঁর প্রেমিককে মা রাধারাণী দেবীর নির্দেশ, ‘‘তিনটি জায়গায় যাওয়া যাবে না। পর্দা টাঙানো কেবিনওয়ালা রেস্তরাঁয়, সন্ধ্যার পরে লেকের ধারে আর সিনেমায়।’’ অগত্যা হেঁটে হেঁটে প্রেমালাপেই দড় হলেন মেয়ে।

স্মৃতিবিজড়িত: জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নবনীতা দেবসেন কাটিয়েছেন ‘ভালো-বাসা’তেই। (ইনসেটে) তাঁর বাবা-মায়ের নামফলক। নিজস্ব চিত্র

স্মৃতিবিজড়িত: জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নবনীতা দেবসেন কাটিয়েছেন ‘ভালো-বাসা’তেই। (ইনসেটে) তাঁর বাবা-মায়ের নামফলক। নিজস্ব চিত্র

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:০৫
Share: Save:

এই বাড়ি জানে তাঁর প্রথম সব কিছুই। প্রথম প্রেম, অভিমান, লেখা, পড়া...। গত মে মাসের এক কথোপকথনে এই বাড়ির দোছাতির (মেজ়েনাইন ফ্লোর) ঘরে বসে নবনীতা দেবসেন শুনিয়েছিলেন তাঁর প্রথম প্রেমের গল্প। তিনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী। মাকে বললেন প্রেম-কথা। মুহূর্তেই মায়ের নির্দেশ, প্রেমিককে আনতে হবে বাড়িতে, ‘ভালো-বাসা’য়।

মেয়ে ও তাঁর প্রেমিককে মা রাধারাণী দেবীর নির্দেশ, ‘‘তিনটি জায়গায় যাওয়া যাবে না। পর্দা টাঙানো কেবিনওয়ালা রেস্তরাঁয়, সন্ধ্যার পরে লেকের ধারে আর সিনেমায়।’’ অগত্যা হেঁটে হেঁটে প্রেমালাপেই দড় হলেন মেয়ে।

এই বাড়ি থেকেই বিদায় নিয়েছে নবনীতার জাগতিক অস্তিত্ব। কিন্তু সে বাড়ির ইট-সুরকি হয়তো বা আঁকড়ে রাখবে লেখিকা, শিক্ষাবিদের বৈদগ্ধ্যকে। তাঁর প্রাণখোলা হাসি-হুল্লোড়কে। বর্তমানের মুহূর্তে অতীত হয়ে যাওয়া আর ভবিষ্যতের মাঝে যোগাযোগ যে বাড়িই, তা মনে করেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও। দু’-তিন বার ‘ভালো-বাসা’য় যাওয়া শীর্ষেন্দুবাবু বললেন, ‘‘বাড়ির সঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে অতীত-কথা, তেমনই তা ভবিষ্যতের দিকেও টানে।’’ কিন্তু সেই টান বর্তমান প্রজন্মের কতখানি, সে বিষয়ে খানিক সংশয়ী শীর্ষেন্দুবাবু।

আরও পড়ুন: তিনি ভরসা জুগিয়েছেন ক্যানসার যুদ্ধেও

বাড়ির বসার ঘর। নিজস্ব চিত্র

‘ভালো-বাসা’র গড়ে ওঠার মধ্যেও রয়েছে এক প্রেম-দায়িত্বের গল্প। সে গল্প রাধারাণীর ‘খুকু’রই (নবনীতার ডাকনাম) বলা। রাধারাণী পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যেই সে সন্তান মারা গেল। মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত রাধারাণীর জন্য কবিরাজ মশাইয়ের পরামর্শে ৭২, হিন্দুস্থান পার্কে জমি কিনে সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনায় রোদ-হাওয়া কোলাকুলি করে, এমন বাড়ি তৈরি করলেন নরেন্দ্র দেব। নাম দেওয়া হল ‘ভালো-বাসা’।

আর সেই বাসা তৈরি হয়েছে নরেন্দ্র-রাধারাণী-নবনীতা, এই পরম্পরার ছায়ায়। সেই ছায়ায় শুধু লেখা-পড়া নয়, ব্যক্তিগত যে কোনও সমস্যাতেও মিলত আশ্রয়, জানাচ্ছেন ‘সই’ (নবনীতার নিজের ভাষায় ‘পশ্চিমবঙ্গ লেখিকা সঙ্ঘ’)-এর সদস্য অনিতা অগ্নিহোত্রী।

সংগঠনটির যাবতীয় কর্মকাণ্ড বসত ওই দোছাতির ঘরেই। দেদার পড়া এবং শোনা, মেলার পরিকল্পনা, ব্যক্তিগত আলাপ— সবেরই সূত্রধর নবনীতা। সেই আশ্রয় সরে যাওয়ায় বাড়িতে শূন্যতা তৈরি হবেই। কিন্তু সেই ‘শূন্য মন্দিরে’ কিছু নৈবেদ্য সাজানো সম্ভব তখনই, যখন নবনীতার কাজের মূল্যায়ন হবে আরও জোরালো ভাবে, মনে করেন অনিতা। একই মত ‘ভালো-বাসা’র ওই বসার ঘরটিতে বহু বার যাওয়া সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় বা বর্তমান প্রজন্মের তিয়াস বসুদেরও।

চার দিকে ঠাসা বইপত্র, এক প্রান্তের দেওয়ালে বাবা-মায়ের ছবি, তাতে রজনীগন্ধার মালা— সুরুচির সেই ঘরের সোফায় বসে একটি স্মৃতির কথাও বলেছিলেন নবনীতা। ছোট্ট খুকুর চোখে ঘুম আনত রাধারাণীর রবীন্দ্রসঙ্গীত—‘তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও, সে ঘুম আমার রমণীয়—’ আর ‘আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী’।

কে জানে, ওই সুরের মধ্যেই হয়তো মেয়ের মধ্যে একটা জেদও তৈরি করে দিয়েছিলেন মা। আর তাই নবনীতা জানিয়েছেন, ‘সই’ শব্দটির বাংলায় তিনটি অর্থ হয়। স্বাক্ষর, সখী ও সহ্য করা। তার পরেই বলছেন, ‘‘তিনটিই আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যুক্ত— শুধু ‘সহ্য করা’টার সঙ্গে কিন্তু সই পাতাব না।’’

সেই না সওয়ার কথা বলা নবনীতাও কিন্তু তাঁর ‘ভালো-বাসা’ নিয়ে চিন্তায়। আর তাই বলে যান, ‘বাড়ির এখনও অদলবদল হয়নি কিছু। জানি না, যখন আমি থাকব না, তখন এ বাড়িটি কেমন হবে।’ (‘নবনীতার নোটবই’) কেমন হবে, অপেক্ষায় রইল বাঙালিও।

অন্য বিষয়গুলি:

Death Nabaneeta Dev Sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE