Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Death

হেমতাবাদের বিধায়কের মৃত্যুতে রহস্য, তদন্তে সিআইডি

ঘটনার খবর জানা মাত্রই বিজেপি নেতা, মন্ত্রী, সাংসদেরা এলাকায় পৌঁছে যান।

দেবেন্দ্রনাথ রায়। নিজস্ব চিত্র

দেবেন্দ্রনাথ রায়। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২০ ০৪:০৭
Share: Save:

উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদের বিধায়ক দেব্রেন্দ্রনাথ রায় (৬৫) গত বছর ২৮ মে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তার পরে তিনি সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হন। ওই এলাকার এই রাজবংশী নেতার ঝুলন্ত দেহ এ দিন উদ্ধার করা হল বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের বালিয়াদিঘি মোড় এলাকায় একটি মোবাইল ফোনের দোকানের বারান্দা থেকে।

ঘটনাস্থলটি তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূর। অভিযোগ, রবিবার গভীর রাতে তাঁকে কে বা কারা ডেকে নিয়ে যায়। তার পরে এ দিন সকালে তাঁর দেহ মেলে। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে দেবেনের গলায় দড়ির ফাঁসের চিহ্ন মিলেছে। বিজেপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঘটনার সিবিআই তদন্ত চেয়ে আজ, মঙ্গলবার গোটা উত্তরবঙ্গে ১২ ঘণ্টার বন্‌ধ পালিত হবে। রাজ্য প্রশাসন ঘটনার সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

রায়গঞ্জ পুলিশ জেলার সুপার সুমিত কুমার বলেন, ‘‘মৃত বিধায়কের পকেট থেকে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার হয়েছে। তাতে তিনি দু’জনক আত্মহত্যার জন্য দায়ী করেছেন।’’ বিধায়কের পা ঝুলন্ত অবস্থায় মাটি থেকে ইঞ্চি সাতেক উঁচুতে ছিল। বাঁ হাত ছিল বাঁধা। এ ছাড়া তাঁর বুক পকেটে ছিল চশমা।

আরও পড়ুন: বিধায়ক-মৃত্যুতে উত্তরবঙ্গ বন্‌ধ ডাকল বিজেপি, তৃণমূল বলল লাশের রাজনীতি

ঘটনার খবর জানা মাত্রই বিজেপি নেতা, মন্ত্রী, সাংসদেরা এলাকায় পৌঁছে যান। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা, রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, রাজ্য থেকে কেন্দ্রের দুই প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী এবং বাবুল সুপ্রিয় টুইট করে ‘পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গলরাজ চলছে’ বলে দাবি করেন। দাবি ওঠে ঘটনার সিবিআই তদন্তেরও। দিলীপ ঘোষ আবার ‘বদলার’ ডাক দেন। যদিও দেবেনবাবুর স্ত্রী চাঁদিমা দেবী বলেন, ‘‘আমার স্বামী অনেক লোককে টাকা ধার দিয়েছিলেন। কেউ বা কারা টাকা শোধ করতে না পেরে স্বামীকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে বলে মনে হচ্ছে। এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতি আছে কিনা বলতে পারছি না।’’ পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘বিজেপি এত অন্যায় করে, যে সাধারণ ঘটনাতেও তারা অন্যায়ের প্রবণতা খোঁজে। আর বিজেপি করলে এমনিতেও মানুষের একটা মানসিক অবসাদ হয়। সবটাই তদন্তসাপেক্ষ। সিবিআইয়ের থেকে অনেক বেশি মামলার সমাধান করেছে আমাদের রাজ্যের পুলিশ।’’

প্রশ্ন যেখানে

• এত রাতে কে ডাকল?

• যার বা যাদের ডাক শুনে বিধায়ক বাইরে গেলেন, তারা কি পূর্ব পরিচিত?

• বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে তাঁর দেহ মিলেছে। এত দূরে গিয়ে আত্মহত্যা?

• খালি পায়ে গেলেন?

• এতটা রাস্তা, কিন্তু দেবেনবাবু্র পায়ে বা কাপড়ে কাদা নেই। কেন?

• হাতে দড়ি বেঁধে তার টানে গলায় ফাঁস লাগানো সম্ভব?

• পা মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে। সন্দেহ এখানেও।

২০১৬ সালে হেমতাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হন দেবেন। তাঁর স্ত্রী চাঁদিমা দেবী বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সিপিএম প্রধান। তাঁদের একমাত্র মেয়ে সৃষ্টি দশম শ্রেণির ছাত্রী। চাঁদিমার দাবি, রবিবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ এক পড়শির বাড়ির থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়িতে ফেরেন দেবেন। তার পরে নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে যান। চাঁদিমা বলেন, ‘‘ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দেখি, উনি নিজের ঘরে নেই। এর পরেই খবর পাই, ওঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, দেবেনকে দুষ্কৃতীরা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছে। চাঁদিমা জানান, এ দিন ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ তাঁরা বাড়ির সামনে মোটরবাইকের আওয়াজও পেয়েছেন। সেই বাইকেই চাপিয়ে দেবেনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে তাঁর সন্দেহ।

আরও পড়ুন: বিধায়কের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ঘিরে উঠছে নানা প্রশ্ন

দেবেন প্রায় আড়াই দশক ধরে বিন্দোলের একটি সমবায় সমিতির চেয়ারম্যানের পদে রয়েছেন। বছর চারেক আগে অবসর নেওয়ার পর তাঁকে পুনর্নিয়োগ করা হয়। তাঁর বহু বিঘা জমিও রয়েছে। চাষবাস থেকেও ভাল রোজগার ছিল বলে দাবি পড়শিদের অনেকের। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, তাই কেউ কখনও দেবেনের কাছে টাকা ধার চাইলে তিনি না করতেন না। সম্প্রতি কি ধার শোধ দেওয়া নিয়ে কারও সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল? চাঁদিমা দেবী স্পষ্ট করে বলতে পারেননি।

বিজেপির জেলা ও রাজ্যে নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, এটি রাজনৈতিক হত্যা। এবং এর পিছনে রয়েছে তৃণমূল। স্থানীয় সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী বলেন, ‘‘মানুষ বলছেন, দেবেনবাবুকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে। এর পিছনে তৃণমূল রয়েছে বলে বাসিন্দারা বলছেন। সিবিআই তদন্ত চাই।’’ তিনি, বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদার, উত্তর মালদহের সাংসদ খগেন মুর্মু যান দেবেনের বাড়িতে। ওই ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবি করে বিকেল পর্যন্ত বালিয়াদিঘি এলাকার রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান বিজেপির নেতা ও কর্মীরা। বিকেলে প্রথমে উত্তর দিনাজপুর বন্‌ধের ডাক দেওয়া হয়। পরে দেবেনবাবুর দেহ রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজেপির যুবমোর্চার রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ সৌমিত্র খাঁ সেখানে যান। বিজেপির দাবিতে সেখানে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট আনিয়ে ময়না-তদন্ত হয়।

বিজেপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল জেলা সভাপতি কানাইয়ালাল আগরওয়াল বলেন, ‘‘আমরাও চাই দেবেনবাবুর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত হোক। হেমতাবাদে তৃণমূলের এত দুর্দিন আসেনি যে, দেবেনবাবুকে খুন করা হবে।’’

সোমবার দুপুরেই সিআইডির হাতে এই তদন্তের দায়িত্ব তুলে দেয় রাজ্য সরকার। রাজ্য পুলিশ সূত্রে খবর, এর পরেই রায়গঞ্জে যান সিআইডির স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেট (উত্তর) ডেভিড ইভান লেপচা। এক সিআইডি কর্তা জানান, ফরেন্সিক এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ওপর তদন্তের অনেক কিছু নির্ভর করছে। তদন্তকারীদের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ এবং অটোপ্সি সার্জেনের সঙ্গে কথা বলে সোমবার ভবানীভবনে প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা।

সিআইডি সূত্রের খবর, বিধায়কের সঙ্গে রবিবার কাদের ফোনে কথা হয়েছিল, সেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে বিধায়কের পরিবারের তরফে দাবি করা হয়েছে, কয়েক জন ওই দিন রাতে দেবেনবাবুকে ডাকেন। সাত দিন আগে কলকাতায় গিয়ে দেবেনের মোবাইল ফোন হারিয়ে যায়। সেই থেকে তিনি স্ত্রীর মোবাইল ব্যবহার করতেন। গত কয়েক দিনে তিনি কার কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তা জানতে চাঁদিমার মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। এর আগে ২০১৮ সালে পুরুলিয়াতে দুই বিজেপি কর্মীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল। সেই দুই ঘটনার তদন্তও সিআইডি করেছিল। খুনের অভিযোগ করা হলেও সিআইডি আদালতে দাবি করে দু’টি ঘটনাই আত্মহত্যা।

অন্য বিষয়গুলি:

Death BJP MLA Hemtabad CID
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy