কলেজ স্কোয়্যারে থেকে রবীন্দ্র সদন পর্যন্ত আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
মহালয়ার এই গুরুত্ব আগে বুঝিনি। মেয়ে নিজে হাতে বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করার পরেও না। প্রতি বার মেয়ের ডিউটি থাকে। ভোরে মহালয়া শুনে বেরিয়ে যায়। কোনও কোনও বার মহালয়ার ভোরটা ওর হাসপাতালেই কাটে। কিন্তু এ বারের পুজো একেবারে আলাদা। মহালয়াও আলাদা। এত দিন মনে হচ্ছিল, আমার বাড়িতে আর কোনও দিন আলো জ্বলবে না। আমার দুর্গার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ বলছি, আমার দুর্গার বিচার এখনও বাকি। দেবীপক্ষের শুরু, বিচারের লড়াইও শুরু। অসুর নিধন হবেই।
তিন বছর আগে মেয়ে হঠাৎ বলল, মা চলো না, বাড়িতে দুর্গাপুজো করি! ধমক দিয়ে বলেছিলাম, পাগল হয়েছিস? দুর্গাপুজোয় প্রচুর খাটনি মা! মেয়ে বলেছিল, তুমি চিন্তা কোরো না। দু’জনে মিলে করলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভোগ রান্না করবে আর আমি পুজোর দিকটা সব সামলে নেব। সেই শুরু। পর পর দু’বার কী ভাল ভাবে যে আমাদের বাড়ির পুজোটা হয়ে গেল বলে বোঝাতে পারব না। গ্যারাজেই প্রতিমা পাতা হল। বাড়ির সামনে প্যান্ডেল। প্রতিদিন লোকজন খেত। আত্মীয়েরা সব চলে আসত মেয়ের ডাকে। ওর মতো মিশুকে মেয়ে হয় না। ওর মধ্যে এমনই মায়া যে কেউ ওর কথা ফেলতে পারত না।
ওর বাবা কাছেই এক জনকে প্রতিমা গড়তে বলে আসত। খুব বড় নয়, পাঁচ ফুট মতো উচ্চতা হবে সেই প্রতিমার। নিজের পছন্দ করা শাড়ি দিয়ে আসত প্রতিমাকে পরাবে বলে। আমায় সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনত প্রতিমার শাড়ি। মহালয়া থেকেই নিরামিষ খাওয়া শুরু হত আমাদের। দশমীতে আমিষ। এত ভাল করে পুজোর জোগাড় করত যে পুরোহিতের ওকে ছাড়া চলত না। আমায় পুজোর দিকে মাথাই দিতে হত না। ভোগের দিকটা সব করতাম। মেয়ে আমার নিরামিষ খেতেই বেশি ভালবাসত। পনির, কচুর শাক, মোচা— ওর পছন্দের খাবারই সকলকে খাওয়াত। প্রতিমা বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের পুজো বলতে ছিল বাড়ি। সকলকে নিয়ে আনন্দ। বন্ধুদের নিয়েই বাড়িতে গল্প করত।
বিসর্জনের পরে একটু মন খারাপ থাকত ওর। আবার ব্যস্ত হয়ে যেত নিজের কাজে। বলত, মা অনেকে এই পুজোর সময়ে খুব কষ্ট পান। ডাক্তারেরা থাকেন না অনেকেই, এই সময়ে। মেয়ে কিন্তু অঞ্জলি দিতে বসেও রোগীর ডাক এলে উঠে যেত। বলত, ‘মানুষের উপরে তো পুজো নয়, বলো মা!’
কী ভাবে যে ও এই রকম তৈরি হয়েছিল, জানি না। আমরা সে ভাবে ওকে কিছুই দিতে পারিনি। টালির চালের ঘর থেকে ওর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু। মাধ্যমিকে স্কুলে দ্বিতীয় হয়েছিল, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম। স্কুলের স্যরেরা ডেকে বলেছিলেন, আলাদা করে মেয়ের প্রতি নজর দিন। বিজ্ঞানে খুব ভাল ছিল আমাদের মেয়ে। কিন্তু অনেক জন শিক্ষককে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না আমাদের। আমিই পড়িয়েছি মাধ্যমিক পর্যন্ত। উচ্চ মাধ্যমিকের সময়ে দু’-একটা বিষয়ে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম। কোনও কিছুর বায়না ছিল না ওর। আমরা তো ওকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়িয়েছি। শুধু বছরের শুরুতে যখন নতুন বই কেনার সময় হত, তখন এর সঙ্গেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বই চাইত। ওইটুকু পেলেই মেয়ে আমাদের খুশি। সেই সব বই কী তাড়াতাড়ি যে পড়ে শেষ করে ফেলত! এখন মনে হয়, যে নামের আগে ডিগ্রি পাওয়ার জন্য এত লড়াই করল মেয়েটা, সেই নামটাই এখন মুছে গিয়েছে। লোকে ওকে অভয়া, তিলোত্তমা বলে ডাকছে। আমার মেয়ের নামটাই মুছে গিয়েছে।
এখন কেউ ফোন করে মেয়ের নাম ধরে কথা বলতে চাইলে বুকটা কেঁপে ওঠে। সে দিনই যেমন ফোন করে মেয়ের নাম করে কথা শুরু করেছিলেন আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজো, যিনি করেন তিনি। দেখলাম, ইতস্তত করছেন। আমরাই বললাম, এ বার তো আর পুজো হবে না! একই রকম ফোন এল প্রতিমা তৈরির বায়না দেওয়া ছিল যাঁকে, তাঁর কাছ থেকে। বাড়ি এসে বায়নার টাকা ফেরত দিয়ে গেলেন ঢাকিও। রামপুরহাটে থাকেন। ফিরে যাওয়ার আগে মাঝবয়সি মানুষটা যে ভাবে কাঁদলেন, তাঁকে শান্ত করার ভাষাই খুঁজে পাইনি।
পরে মনে হয়েছে তাঁকে দাঁড় করিয়ে বলা যেত, বাজনা চাই তো! খবর দেব আপনাকে। অসুর নিধনের সময় হয়ে এসেছে। অনেক দুর্গা রাস্তায় নেমেছে। দেবীপক্ষ শুরু।
অনুলিখন: নীলোৎপল বিশ্বাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy