এক বইয়ের পাতা কেটে বসিয়ে নওলাখা হার চালানের চেষ্টা হয়েছিল গল্পে। বাস্তবে একই পথে জেলের মধ্যে ব্যবহার হচ্ছিল মোবাইল ফোন।
সত্যজিৎ রায়ের ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’য় ফেলুদার খপ্পরে পড়ে ঋষি অরবিন্দের ‘লাইফ ডিভাইন’-এর মধ্যে হার চালান করার পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল বারেন্দ্র সান্যাল ওরফে মিস্টার গোরের। এ বার আচমকা তল্লাশিতে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল বর্ধমান জেলা সংশোধনাগারে। তবে ভাগবৎ গীতার পাতা কেটে বন্দিদের এই মোবাইল ফোন রাখার ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে জেল-অন্দরের নিরাপত্তা নিয়েই।
রাজ্যের কারামন্ত্রী অবনীমোহন জোয়ারদার বলেন, ‘‘মাঝে-মাঝে এ রকম ঘটনা ঘটে যায়। একেবারেই অনভিপ্রেত। পুরনো জেলগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা-সহ নানা সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছে। প্রয়োজন মতো জ্যামার বসানোর ভাবনাও রয়েছে।’’
এ রাজ্যের জেল থেকে বন্দিদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নতুন নয়। নানা সময়ে দমদম বা আলিপুর জেল থেকে গুড্ডা-গব্বর-শেখ বিনোদ, যীশুর মতো দুষ্কৃতীরা মোবাইলেই দল চালানো, সাক্ষীদের হুমকি দেওয়া, তোলাবাজির মতো কাণ্ড-কারখানা করেছে। খাদিম-কর্তা অপহরণ ও অ্যামেরিকান সেন্টারে হানাদারির ‘হাই প্রোফাইল’ বন্দি আফতাব আনসারি ‘ফেসবুক অ্যাকাউন্ট’ খোলা, ‘স্কাইপ’ ব্যবহার এবং পাকিস্তানের করাচিতে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিল জেল থেকেই মোবাইল-যোগে। আলিপুর জেল থেকে কলকাতার তৃণমূল নেতা শম্ভুনাথ কাও ফোন করে বসেছিলেন দলেরই নেতা-মন্ত্রীদের।
বর্ধমান জেলেও বন্দিদের হাতে যে মোবাইল ঘোরাফেরা করে, মালুম হয়েছিল মাসখানেক আগেই। এক বন্দি নিয়মিত ‘ফেসবুক’-এ ছবি ‘আপলোড’ করছিলেন। পুলিশ সূত্রের দাবি, তদন্তে নেমে তাদের মনে হয়েছিল, কারারক্ষীদের কেউ-কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। দু’জন রক্ষীকে গ্রেফতারও করা হয়। পুলিশের দাবি, তখনই জানা গিয়েছিল, অনেক সময় বন্দিদের পরিজনেরা মোবাইল ভরা ছোট টিফিনবাক্স কিছু কারারক্ষী মারফত পৌঁছে দিচ্ছেন ভিতরে।
এক পুলিশ-কর্তা জুড়ে দিচ্ছেন, ‘‘জেলের এক দিকে পাঁচিল ঘেঁষে রয়েছে বস্তি এলাকা। সেখান থেকে প্লাস্টিক বা সাবানের খাপে ভরে ভিতরে মোবাইল ছুড়ে দেওয়া হয় বলেও জানা গিয়েছে।’’
কারা-কর্তাদের নজর এড়িয়ে বন্দিরা মোবাইল ব্যবহার করছে কী ভাবে? বৃহস্পতিবার রাতে জেল পরিদর্শনে গিয়ে সেই উপায় দেখে তাজ্জব পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। প্রতিটি ওয়ার্ডেই বন্দিদের জন্য প্রার্থনা করার জায়গা থাকে। সেখানে রয়েছে ধর্মগ্রন্থ রাখার ব্যবস্থাও। এমনই এক জায়গায় একটি বই উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে কর্তাদের চোখে পড়ে, গোটা কুড়ি পাতা কেটে একেবারে মোবাইলের মাপে জায়গা করে রাখা হয়েছে। তা দেখেই তল্লাশি শুরু হয়। একে একে বন্দিদের কাছ থেকে মেলে মোট ১২টি মোবাইল।
নানা উৎসবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বন্দিদের ধর্মগ্রন্থ দেয়। বন্দিদের চুল-দাড়ি কাটার জন্য ব্লেড নিয়ে যান নাপিতেরা। জেল-কর্তাদের অনুমান, সুযোগ বুঝে ব্লেড সরিয়ে রেখেছিল বন্দিরা। তা দিয়েই বইয়ের পাতা এমন মাপ করে কাটা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ জেল-কর্তাদের। তবে প্রশাসনের কর্তাদের মতে, নজরদারির অভাবই মূল কারণ। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সীমানা পাঁচিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত টহল দিতে অন্তত ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। রক্ষী মাত্র তিন জন। সুযোগ বুঝে ২৫-৩০ ফুট উঁচু পাঁচিল টপকে মোবাইল ভিতরে ছুড়ে দেওয়া হয় বলে মনে করা হচ্ছে।’’ বর্ধমান সংশোধনাগারের সুপার শুভেন্দুকৃষ্ণ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সবে এসেছি। জেলের পাঁচিলের বাইরে যাতে টহল বাড়ানো হয়, পুলিশকে সে জন্য বলা হয়েছে।’’ রাজ্যের এডিজি (কারা) অরুণ গুপ্ত অবশ্য বললেন, ‘‘নিয়মিত তল্লাশির ফলেই মোবাইলগুলি উদ্ধার হয়েছে। কী ভাবে সেগুলি জেলে ঢুকল, তা তদন্তসাপেক্ষ।’’
মোবাইল-উদ্ধার পর্বে জড়িত প্রশাসনের এক কর্তার টিপ্পনী, ‘‘বন্দিরা কী ভাবে চুপিসারে এত কিছু করল, তা চিন্তায় ফেলছে। মনে হচ্ছে, কোথাও যেন মগজাস্ত্র কম পড়ছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy