বাঁ দিকে, ছেলে সাবিরের ছবি হাতে জাহানারা বেগম। ডান দিকে, কাঞ্চনের মা মিনতি গড়াই এবং বাবা বাসুদেব গড়াই। —নিজস্ব চিত্র।
অভাবী হলেও সংসারে শান্তি ছিল। আজ হাতে টাকা যা-ও বা রয়েছে, খালি হয়ে গিয়েছে কোল। নিথর দেহ ছুঁয়ে দেখার অবকাশটুকুও মেলেনি। কাল ছিল, আজ যেন কোথায় উবে গিয়েছে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে স্মৃতিও। সেই হাহাকারই কোথাও যেন মিলিয়ে দিয়েছে মিনতি গড়াই এবং জাহানারা বেগমকে। মাওবাদী হানায় দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ‘নিখোঁজ’ সন্তানের শোক বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। এমন শোক, খাতায় কলমে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। আবার শেষ নেই অন্তহীন অপেক্ষারও। তাই সংসারের মায়ায় জড়িয়ে থেকেও স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝেই আটকে রয়েছেন দু’জন।
২০০৯ সালের ৩০ জুলাই। রাজ্যে তখনও লালদুর্গ অটুট। সবুজ ঝড়ে ক্রমশ তা নড়বড়ে হচ্ছে। সেই সময়ই এক সকালে রাজ্যের মানুষের ঘুম ভেঙেছিল জঙ্গলমহলের দুই তরুণ কনস্টেবল, কাঞ্চন গড়াই এবং সাবির মোল্লার ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়ার খবরে। রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ১৩ নম্বর ব্যাটালিয়ানে কর্মরত ছিলেন কাঞ্চন এবং সাবির। লালগড় থানার অন্তর্গত ধরমপুর শিবিরে মোতায়েন ছিলেন তাঁরা। ওই দিন সকালে শিবিরের জেনারেটর বিকল হয়ে পড়ে। সেটি সারাতে দু’জনে মিলে বাইকে চেপে যন্ত্রপাতি কিনতে বেরিয়েছিলেন। সেই শেষ যাওয়া। আর ফেরেননি কাঞ্চন এবং সাবির। পুলিশ জানায়, ধরমপুর থেকে লালগড় যাওয়ার পথে তাঁদের অপহরণ করে মাওবাদীরা।
অন্য খবরের মতো দুই তরুণের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার এই ঘটনা ঘরের কোণে জমিয়ে রাখা কাগজের তাড়ার নীচে ধামাচাপা পড়তে না দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লির দরবার পর্যন্ত এই ঘটনাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দুই তরুণের পরিবারকে নিয়ে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের কাছে হাজির হয়েছিলেন। ওই দুই তরুণকে ‘জঙ্গলমহলে বাম সরকারের অপশাসনের বলি’ বলে অভিযোগ করেছিলেন।
তার পর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। সে দিনের বিরোধী নেত্রী আজ শাসকের আসনে। কিন্তু মিনতি, জাহানারা আজও সরকারের একটা সিলমোহরের আশায় বসে। ছেলে ফিরবে না, এই কয়েক বছরে মোটামুটি বুঝে গিয়েছেন তাঁরা। অন্তত মৃত্যুর খবরটুকু যদি নিশ্চিত ভাবে জানা যায়, সেই আশায় দিন গুনছেন তাঁরা। তাতে অন্তত বুকের উপর থেকে পাথরটা নেমে যায়। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছরেও ছেলের নামের পাশ থেকে ‘মিসিং অন ডিউটি’ অর্থাৎ কর্তব্যরত অবস্থায় নিখোঁজ লেখাটি ওঠেনি। এমনকি ২০১৫ সালে লালগড়ের জঙ্গল থেকে যে হাড়গোড় উদ্ধার হয়, তা কাঞ্চন এবং সাবিরের কি না জানতে যে ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছিল, আজও দুই পরিবারের হাতে তার রিপোর্ট পৌঁছয়নি।
সন্তানশোক ভুলে ‘স্বাভাবিক’ হতে যদিও চেষ্টা কম করেননি মিনতি। শুয়ারাবাঁকড়া গ্রামের একচিলতে বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে উঠে এসেছেন বড়জোড়ার কাছে কাদাশোল গ্রামে। এক আত্মীয়ের বাড়ির পাশে ভাড়া থাকেন। কিন্তু শূন্যতা মেটেনি। আঁচলে চোখের জল মুছে মিনতি বলেন, ‘‘আমি রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি। বলি, আমার কাঞ্চনকে ফিরিয়ে দাও।’’
প্রান্তিক কৃষক পরিবারে জন্ম কাঞ্চনের। বাড়ির ছোট ছেলে। ঘোষের গ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি সশস্ত্র পুলিশের ১৩ নম্বর ব্যাটালিয়নে কনস্টেবল পদে যোগ দেন। ২০০৯ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝিই বদলি হয়ে ধরমপুরে মোতায়েন হন। কাঞ্চনের বাবা বাসুদেব গড়াই জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও তাঁদের খোঁজ নিতে ভোলেননি মমতা। কর্তব্যরত অবস্থায় ছেলে নিখোঁজ হওয়ায়, আজও প্রতি মাসে তার প্রাপ্য বেতনের টাকা হাতে পান তাঁরা। তাঁদের অন্য দুই ছেলের মধ্যে বড় চিত্তরঞ্জন গড়াই পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। মেজ ছেলে ত্রিলোচন দোকান চালান বড়জোড়ায়। কিন্তু ছোট ছেলে কাঞ্চনের পরিণতি জানা নেই তাঁদের।
শুধু তাই নয়, ছেলের বেতনের টাকা পেলেও অন্যান্য প্রাপ্য থেকে তাঁরা বঞ্চিত বলেও অভিযোগ করেন বাসুদেব। তিনি বলেন, ‘‘২০০৯ সালে যা বেতন পেত ছেলে, আজও সেটাই পাই আমরা। অথচ বর্ধিত মাহার্ঘভাতা, বেতনবৃদ্ধি, সপ্তম বেতন কমিশনের সুবিধা নিয়ে তার সতীর্থরা বর্তমানে তিন গুণ টাকা পান। আমরা সে সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কাঞ্চন যদি আজও অন ডিউটি থাকে, তা হলে তার প্রাপ্য বর্ধিত বেতন কেন পাব না আমরা? সাহসের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিল আমার ছেলে। তাই সরকারের তরফে সবরকম সম্মান তার প্রাপ্য। তবেই তো অন্যরা আগামী দিনে উৎসাহিত হবে!’’
বার বার এ নিয়ে কলকাতায় গিয়েও সুরাহা হয়নি বলে জানান কাঞ্চনের দাদা চিত্তরঞ্জন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার এবং মানবিক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ আমাদের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখুন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কাঞ্চনকে যারা অপহরণ করেছিল, ২০১১ সালের পর থেকে একে একে আত্মসমর্পণ করেছে তারা। এই অবস্থায় ভাইয়ের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তবু বাবা ও মা বাস্তবটা মানতে চান না। ভাবেন, কোথাও না কোথাও ঠিক রয়েছে কাঞ্চন। এক দিন ফিরবেই।’’
স্বামীর অবর্তমানে চার ছেলে, এক মেয়েকে একাহাতে বড় করেছেন। কিন্তু ছোট ছেলে সাবিরের কথা উঠতেই আবেগের বাঁধ ভাঙল পূর্ব বর্ধমানের মেমারি থানার অন্তর্গত তেলসরা গ্রামের বাসিন্দা জাহানারার। নীল পাড় সাদা শাড়িতে চোখের জল মুছে পুলিশের উর্দি পরে তোলা ছেলের ছবিটা সামনে মেলে ধরলেন। জাহানারা জানান, ২০০২ সালে মৃত্যু হয় স্বামী ইব্রাহিম মোল্লার। তার পর মায়ের সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ে নামে ছেলেমেয়েরাও। ২০০৬ সালে ব্যারাকপুরে প্রশিক্ষণ শেষ হয় সাবিরের। ছেলে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সত্যিই সত্যিই সুদিন ফেরে পরিবারে। ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই ধরমপুরে পোস্টিং হয়।
জাহানারাকে সঙ্গে করে চিদম্বরমের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন মমতা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে আশ্বাসও পেয়েছিলেন জাহানারা। কিন্তু ১২ বছরেও ছেলের কোনও হদিশ পাননি তিনি। তাই জাহানারার গলায় আক্ষেপ, ‘‘১২টা বছর কেটে গেল। দু’জনে বাইকে চেপে যাচ্ছিল। মাওবাদীরাই অপহরণ করে। কিন্তু এত বছরেও কোনও কূল কিনারা নেই। এত দিন কেটে গিয়েছে। এ বার হয়তো দু’জনকেই মৃত বলে ঘোষণা করে দেবে রাজ্য প্রশাসন। দুই মায়ের কোলই খালি হয়ে যাবে।’’
সাবির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর, তাঁর দাদা সামাদ মোল্লা এবং শরিফ মোল্লা পুলিশের চাকরি পেয়েছেন। পাশাপাশি প্রতি মাসে সাবিরের বেতনের টাকাও মায়ের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। কিন্তু কাঞ্চনের পরিবারের মতো তাঁরাও অভিযোগ করেছেন যে, ২০০৯ সালে সাবির যা বেতন পেতেন, এখনও সেই টাকাই অ্যাকাউন্টে ঢোকে। শুধু তাই নয়, মাও অধ্যুষিত এলাকায় কর্মরত পুলিশকর্মীরা যে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত বেতন পান, সেটাও দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেছে সাবিরের পরিবার। এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছেন জাহানারা।
নিখোঁজ ছেলেদের জন্য পথ চেয়ে আজও রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন দুই মা। আজও দরজায় কেউ কড়া নাড়লে মনে হয় ফিরে এল এক যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলে। কিন্তু দিনের শেষে দুই মায়েরই সঙ্গী চোখের জল আর সরকারি আশ্বাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy