দিঘায় বিকোচ্ছে ইলিশ। —ফাইল চিত্র।
কবে পাতে মিলবে ‘রুপোলি শস্য’— কার্যত এই অপেক্ষাতেই বছরভর দিন কাটে ভোজন রসিক আম বাঙালির। ইলিশের ঝাল, ভাপা ইলিশ, ইলিশের পাতুরি, সর্ষে ইলিশ— নাম শুনলেই বাঙালির জিভে আসে জল। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে সম্প্রতি মরসুমের প্রথম ইলিশের দেখা মিলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘায়।
সমুদ্রে মাছ ধরার উপর ‘ব্যান পিরিয়ড’ শেষ হওয়ার পর কয়েকদিন পূবালি হাওয়ার সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টির হাত ধরেই মরসুমের প্রথম ইলিশের দেখা মিলেছে দিঘায়। গত সপ্তাহে দিঘার বাজারে ৩০ টনেরও বেশি ইলিশ আমদানি হয়েছে— এমনটাই জানানো হয়েছে ‘দিঘা ফিশারম্যান অ্যান্ড ফিস ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন’এর পক্ষ থেকে। ফলে আগামী কয়েক দিনে ইলিশের দাম বেশ কিছুটা কমবে বলে আশাবাদী বাঙালি।
গত ১৫ জুন শেষ হয়েছে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের জারি করা ‘ব্যান পিরিয়ড’এর মেয়াদ। এ বছর মাছ ধরার মরসুম শুরু হওয়ার পরে এক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মৎস্যজীবীদের জালে উঠেছে রাশি রাশি রুপোলি শস্য। যা দেখেশুনে হাসি ফুটেছে ট্রলার মালিক থেকে শুরু করে মৎস্যজীবীদের মুখে।এ বছর অবশ্য মরসুম শুরু হওয়ার পর একদিনে ১০ টন ইলিশ মাছ আমদানি হয়েছিল দিঘায়। মঙ্গলবার দিঘা মোহনায় ফিরে এসেছে বহু ট্রলার। সেই সব মৎস্যজীবীদের জালে প্রায় ৩৫ টনেরও বেশি ইলিশ মাছ ধরা পড়েছে। এ দিন সকালে দিঘা মোহনা মাছ নিলাম কেন্দ্রে প্রায় ২৫-৩০ টন ইলিশ বিক্রি হয়েছে বলে খবর। এ ছাড়াও আরও ১০ থেকে ১৫ টন ইলিশ নিয়ে বেলা বাড়ার পর বেশ কয়েকটি ট্রলার এসে পৌঁছেছে বলে খবর।
দিঘা এবং কাঁথি এলাকায় বিভিন্ন বাজারে ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি দরে। আর ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হয় ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে। ট্রলার মালিকেরা জানাচ্ছেন, যে পরিমাণ ইলিশ মাছ মৎস্যজীবীদের জালে ধরা পড়েছে তার ১০ শতাংশ এক কেজি বা তার বেশি ওজনের। তবে ৪০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছের জোগানও স্বাভাবিক। গত কয়েকদিনে সে ভাবে জেলায় বৃষ্টি হয়নি। তবে উপকূলবর্তী এলাকায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি এবং পূবালি হাওয়া রয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটের কারণে কয়েকদিন সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ ছিল। ভোট দিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে পুনরায় মৎস্যজীবীরা মাছ ধরার উদ্দেশে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছেন। আগামী কয়েক দিন এমন আবহাওয়া থাকলে ইলিশের খরা কাটবে বলেও আশা করছেন মৎস্যজীবীরা। পাশাপাশি, ইলিশের দামও নাগালের মধ্যে চলে আসতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
‘দিঘা ফিশারম্যান অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স আসোসিয়েশন’এর সম্পাদক শ্যামসুন্দর দাস বলেন, ‘‘শুক্রবার প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ টন ইলিশ উঠেছে দিঘা মোহনায়। এ বছর প্রকৃতি কিছুটা সহায়ক। আশা করি আগামী কয়েক দিনে ইলিশের আমদানি আরও বাড়বে। তখন দামও কমে যাবে। আমরা চাই সব বাঙালির পাতে ইলিশ পড়ুক।’’ ‘দিঘা ফিশারমেন অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স আসোসিয়েশন’এর সভাপতি প্রণবকুমার কর বলেন, ‘‘মরসুম শুরু হওয়ার পর থেকে কম-বেশি ইলিশের আমদানি হচ্ছে। আকারেও মোটামুটি স্বাভাবিক। প্রকৃতি এ বার যে ভাবে অনুকূল তাতে ফিশিং ট্রলারগুলিতে আরও ইলিশ মাছ ধরা পড়বে বলে মনে হয়।’’
ইলিশ মূল গভীর জলের মাছ হলেও, পূর্ব মেদিনীপুরের রূপনারায়ণের ইলিশের খ্যাতিও সারা রাজ্যে। কোলাঘাটে মূলত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রথম দফায় ইলিশ ধরা হয়। তারপর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় দফা। কোলাঘাটের দেনান, বাঁপুর, জামিট্যা ইত্যাদি এলাকায় রূপনারায়ণে ইলিশ ধরা হয়। ইলিশ গভীর জলের মাছ হলেও, বর্ষায় এরা ডিম পাড়তে আসে মিষ্টি জলে। আবার ইলিশের প্রিয় খাবার হল রটিফার নামে এক ধরনের জ়ু-প্ল্যাঙ্কটন। যা রূপনারায়ণে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। আগে হুগলি নদীর গেঁওখালি হয়ে রূপনারায়ণের মিষ্টি জলে ঢুকত ডিম ভরা ইলিশ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোলাঘাট বাজার এলাকায় রূপনারায়ণে ৫০০ মিটারের মধ্যে সড়ক ও রেলের হয়ে মাথা তুলেছে মোট পাঁচটি সেতু। সেতুগুলির মোট পিলারের সংখ্যা ৪২। বিশালাকার সেতুগুলিতে স্রোত ধাক্কা খেয়ে রূপনারায়ণে ক্রমশ জমছে পলি। তৈরি হয়েছেবিশাল চরও।
আবার কয়েক বছর আগে কোলাঘাটের বিপরীতে হাওড়ার নাওপালা এলাকায় রূপনারায়ণের পাড়ে একটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে। সেখানকার দূষিত জল এসে মিশছে রূপনারায়ণে। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষিত জলও এসে পড়ে রূপনারায়ণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির দূষিত জল রূপনারায়ণে মেশার কারণে মুখ ফিরিয়েছে ইলিশের ঝাঁক। এর পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে। ফলে মিলছে না বড় আকারের ইলিশ। এ বার বর্ষার শুরুতে কোলাঘাটে জেলেদের জালে একেবারেই ইলিশ উঠছে না বলে দাবি। মাঝে মধ্যে দু’-চারটে ইলিশ ধরা পড়লেও তা সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ব্যবসায়ীরা দিঘার ইলিশ এনে বিক্রি করছেন এলাকায়। কোলাঘাট, মেচেদা, তমলুক এবং দেউলিয়া মাছ বাজারে প্রতিদিনই দিঘারইলিশ আসছে।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, দিঘা থেকে আসা ইলিশগুলি ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের এবং সেগুলি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হচ্ছে। কোলাঘাট, মেচেদা, তমলুক এবং দেউলিয়া— এই চারটি মাছ বাজারে প্রতিদিন গড়ে দিঘা থেকে দেড় থেকে দু’-কুইন্টাল করে ইলিশ আসছে। বড় আকারের মাছ না আসায় কোলাঘাটের বড় আড়তদাররা ওই মাছ কিনছেন না। ফলে মূলত ছোট ব্যবসায়ীরা গ্রামেগঞ্জের বাজারগুলিতে দিঘার ইলিশ বিক্রি করছেন। কোলাঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী শ্রীমন্ত দাসের কথায়, ‘‘কোলাঘাটে এখন আর বাণিজ্যিক হারে ইলিশ ধরা পড়ে না। মাঝে মধ্যে কপাল ভাল থাকলে জেলেদের জালে দু’-চারটে করে ইলিশ ধরা পড়ে। দিঘা থেকে প্রতিদিন কোলাঘাটে ইলিশ আসছে। এখনও বাজারে বড় আকারের ইলিশের দেখা মেলেনি। বাধ্য হয়ে জেলেরা মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে অন্য জীবিকা খুঁজে নিচ্ছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy