পুরভোটে গেরুয়া শিবিরের লড়াইয়ে ‘মধ্যমণি’ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
ভোটগ্রহণ রবিবার। শতাধিক পুরসভায় নির্বাচন। কিন্তু তাদের সকলের থেকে একেবারে আলাদা উত্তেজনা পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে অধিকারী পরিবারের দখলে থাকা এই পুরসভায় কি এ বারও উড়বে ঘাসফুলের জয়ধ্বজা? এ নিয়েই জল্পনা তুঙ্গে ‘বালি পাহাড়ের দেশ’ কাঁথির আনাচে-কানাচে। কারণ, গত পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম বার কাঁথি পুরনির্বাচনে অধিকারী পরিবারের কোনও প্রার্থী নেই। যদিও এই পুরভোটে গেরুয়া শিবিরের লড়াইয়ে ‘মধ্যমণি’ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। নীলবাড়ির লড়াইয়ে যিনি জেলারই নন্দীগ্রাম বিধানসভা আসন থেকে জিতেছেন। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন স্বয়ং তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মত, এ বারের কাঁথি পুরভোট নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, গত কলকাতা পুরভোট এবং সদ্য শেষ হওয়া রাজ্যের চার পুরনিগমে বিজেপি-র খারাপ ফলের পর শুভেন্দুকে ঘরের মাঠেও ধরাশায়ী হতে হলে বাংলায় গেরুয়া শিবিরের মনোবল চূড়ান্ত ভাবে ধাক্কা খাবে। পাশাপাশি, অধিকারী পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও উঠবে প্রশ্ন। অন্য দিকে, তৃণমূলের জন্য এই লড়াই শুভেন্দুর ‘দর্পচূর্ণ’ করার লড়াই। কাঁথির জোড়াফুল শিবিরের বক্তব্য, গত বিধানসভায় নন্দীগ্রামে দলনেত্রী মমতাকে হারানো নিয়ে শুভেন্দুর মধ্যে যে ‘দম্ভ’ তৈরি হয়েছে, তাতে আঘাত হানাই এখন মূল লক্ষ্য। রাজ্যের মন্ত্রী অখিল গিরির ছেলে সুপ্রকাশ গিরি বলেন, ‘‘এ বার কাঁথি পুরসভা থেকে অধিকারী পরিবারকে সম্পূর্ণ উৎখাত করতে হবে। পুরসভার ২১টি ওয়ার্ডকেই করতে হবে বিরোধীমুক্ত।’’
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ থেকেই অধিকারী পরিবারের দখলে কাঁথি পুরসভা। ১৯৬৯ সালে প্রথম বার পুরসভার কাউন্সিলর হন শিশির অধিকারী। এর পর কংগ্রেসের টিকিটে জিতে ১৯৭১-’৮১ পর্যন্ত টানা ১০ বছর পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। মাঝে পাঁচ বছরের বিরতির পর ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আবারও চেয়ারম্যানের পদ সামলান শিশির। এর পর বাবার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে বসেন শুভেন্দু। ২০১০ থেকে এক টানা ১০ বছর শিশির-পুত্র সৌম্যেন্দু অধিকারীর হাতে ছিল কাঁথি পুরসভার ব্যাটন। ২০২০ সালে পুরবোর্ডের কার্যকাল শেষ হলে ওই বছরের প্রায় শেষ পর্যন্ত প্রশাসক বোর্ডের দায়িত্ব সামলান তিনি।
শান্তিকুঞ্জের অধিকারী পরিবারের দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবেই পরিচিত কাঁথি পুরসভার প্রশাসনিক ভবন। পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দোতলায় সিঁড়ির পাশের ঘরটিতে বসতেন শিশির। পরে চেয়ারময়ান পদ ছেড়ে দিলেও দীর্ঘকাল যাবৎ ওই ঘরটির দরজায় জ্বলজ্বল করত শিশিরের নামাঙ্কিত বোর্ড। সাংসদ হওয়ার পরেও এলাকার মানুষদের সঙ্গে এখানেই দেখা-সাক্ষাৎ করতেন তিনি। দোতলার শেষ প্রান্তের একটি ঘর পান মেজো ছেলে শুভেন্দু। সেজো ছেলে দিব্যেন্দু কাউন্সিলর হওয়ার পর তাঁর জন্যেও একটি ঘর বরাদ্দ হয়। সৌম্যেন্দু ২০১০-এ পুরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে একটি ঘর পান। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর শুভেন্দু বিজেপি-তে যোগদানের পর সৌম্যেন্দুকে প্রশাসকের পদ থেকে সরিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। সেই সঙ্গে অধিকারী পরিবারের জন্য বরাদ্দ ঘরের দরজা থেকে সরিয়ে ফেলা হয় শিশির, শুভেন্দু, দিব্যেন্দু ও সৌম্যেন্দুর নামাঙ্কিত বোর্ড।
কাঁথির লড়াই যে শুভেন্দুদের সম্মানরক্ষার লড়াই, তা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন অধিকারী পরিবারের ঘনিষ্ঠেরা। পাশাপাশি, এ বারের লড়াই যে ‘জলবৎ তরলং’ হবে না, তা-ও মেনে নিচ্ছে যুযুধান দুই পক্ষই। কাঁথির রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ২, ৬, ৮, ১১, ১৩ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে। আবার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কনকপুর ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শক্ত ঘাঁটি’, তাই ওখানে বেশ বেগ পেতে হবে জোড়াফুল শিবিরকে।
বিজেপি-র কাঁথি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সুদাম পণ্ডিত অবশ্য প্রকাশ্যে বলছেন, ‘‘গত বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে ২১ ওয়ার্ডের মধ্যে এগিয়ে থাকা ১৮ ওয়ার্ডেই জিতবে বিজেপি।’’ অন্য দিকে, তৃণমূল নেতাদের পাল্টা দাবি, বিধানসভা নির্বাচনে ভাল ফল করলেও সাংগঠনিক শক্তি ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। ভোট-প্রচারে তা সর্বত্র চোখে পড়েছে। উল্টে, শক্তি বেড়েছে তৃণমূলের। এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘পরিস্থিতি প্রতিকূল বূঝতে পেরে শুধু কাঁথিতেই নয়, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ও এগরা পুরনির্বাচনেও আমরা ভোটগ্রহণে বাধা দিতে পারি বলে মিথ্যে অভিযোগ করছেন শুভেন্দু।’’
এই দাবি-পাল্টা দাবি ঘিরে সরগরম গোটা পূর্ব মেদিনীপুর। ভোটের আগের দিন কার্যত থমথমে ছবি দেখা গেল কাঁথিতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওড়িশা ও দিঘা সীমানায় কড়া নজরদারি চালাচ্ছে পুলিশ। পুলিশি তৎপরতা বেড়েছে তমলুক ও এগরায়। কাঁথির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে শুক্রবার রাতে বিজেপি কর্মীদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে। তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির তলায় থাকা শুভেন্দুর নামাঙ্কিত পাথরে কালি লেপে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন বিজেপি-র তমলুক সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তমলুক শহর তৃণমূল কমিটির নেতা চন্দন দে।
জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, দু’একটি ছোটখাটো অশান্তি ছাড়া বড় কোনও অভিযোগ নেই। ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত বাহিনী রয়েছে বলেই জানানো হয়েছে। জেলা প্রশানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কাঁথি, তমলুক ও এগরা পুরসভার ৫৫ ওয়ার্ডের ১৬৮টি বুথে মোট ১ হাজার ২০০ জওয়ান মোতায়েন থাকবে। জেলার তিন পুরসভা মিলিয়ে মোট ভোটার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫৪২ জন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy