গোয়ালতোড়ের দুর্গাবাঁধ বীজখামারের জমিতে গড়ে উঠছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। নিজস্ব চিত্র।
'নাকের বদলে নরুন পেলাম... তাক দুমাদুম দুম'। মান্না দে'র জনপ্রিয় গানটা শোনেননি ষাট পেরনো মুরারি মণ্ডল। দুর্গাবাঁধে সরকারি বীজখামারের জমিতে ভাঙাচোরা চা দোকানের মালিক মুরারির মনে এখন উচ্ছেদের আশঙ্কা।
কেন? সকালে কাঠের উনুনে কালো ভুসো পড়া কেটলি বসিয়ে মুরারির জবাব, ‘‘যা কাজ শুরু হয়েছে, আমার ৪৫ বছরের চা দোকানটাই না তুলে দেয়!’’ কী কাজ? ‘‘দেখছেন না সোলার লাইটের দক্ষযজ্ঞ চলছে’’, বললেন বৃদ্ধ।
সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দেখে স্থানীয়রা সব থ। কোথাও সোলার প্লেট বসছে, কোথাও হচ্ছে রাস্তা। বুলডোজার থেকে আধুনিক যন্ত্র, ছোট-বড় নানা গাড়ি, ইঞ্জিনিয়ার আর শ্রমিকদের ছোটাছুটিতে বীজখামার জুড়ে তুমুল ব্যস্ততা। তা দেখতে মাঝেমধ্যেই আশেপাশের লোকও জড়ো হচ্ছে। তবে তাঁরা বুঝতেই পারছেন না নির্মীয়মাণ পূর্ব ভারতের অন্যতম বৃহৎ এই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র তাঁদের কতটা উপকার করবে।
গোয়ালতোড়ের জিরাপাড়া অঞ্চলের দুর্গাবাঁধ সরকারি বীজখামারের জমিতে এক দশক আগে শিল্পতালুক গড়ার কথা জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। এখন বীজখামারের প্রায় সবটা জমিতেই গড়ে উঠছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। মূল তত্ত্বাবধানে রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি লিমিটেড (ডব্ল্যুবিএসইডিসিএল)। গোয়ালতোড়ে প্রস্তাবিত শিল্পতালুকের জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে রাজ্যের সঙ্গে এক জার্মান সংস্থার মউ স্বাক্ষর হয় গত বছরের গোড়ায়। জার্মান প্রতিনিধিরা এসে জমি দেখেন। রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছ থেকে জমি নেয় রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি লিমিটেড। মাটি পরীক্ষার পর গত বছর মার্চে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল, সোলার প্যানেল বসিয়ে ১২৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে এখানে। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঠিক হয় এখানে ৯টি সোলার ইউনিট বসানো হবে। প্রতিটি ইউনিট থেকে ১২.৫ মেগাওয়াট করে সৌর বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, অর্থাৎ সবমিলিয়ে ১১২.৫ মেগাওয়াট। উদ্যোক্তাদের দাবি, একই চত্বরে এত বড় সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প পূর্ব ভারতে কার্যত নেই। প্রকল্প দেখভালে নিযুক্ত রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ফটোভোলটাইপ সেল বসানো হচ্ছে। সূর্যের আলো সেই সেলে পড়ার পর সেগুলি সক্রিয় হবে। পুরো নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা এ বছর অগস্টেই।’’
গোটা চত্বরে এখন কর্মব্যস্ততার ছাপ। নীল-সাদা দেওয়াল বরাবর চকচকে প্রশস্ত রাস্তার পাশে ‘গোয়ালতোড় শিল্পতালুক’ লেখা মাইলফলক টপকে ভেতরে ঢুকতেই ‘রোড ক্লোজড’ বোর্ড। ‘সোলার পিভি প্রজেক্ট’ লেখা দিকনির্দেশ বোর্ড বসিয়ে মাটির রাস্তায় বড় স্টোনচিপস ফেলা হয়েছে। তৈরি হচ্ছে রাস্তা। এ দিক-ও দিক পড়ে আছে কাটা কাজুবাদাম ও ইউক্যালিপটাস গাছ। একটু এগোতেই দেখা গেল— একের পর এক সোলার প্যানেল বসানো ছাউনি। ভেতরে আরও বড় একটা অংশেও দেখা গেল একই ছবি। প্রকল্প এলাকায় রয়েছে অফিস, ঘেরা হয়েছে যন্ত্রাংশের পৃথক স্থান। শ্রমিকরা কাজ করছেন নানা প্রান্তে।
কিন্তু যে শিল্পতালুকে এক সময় গাড়ি তৈরির কারখানার হবে বলেছিলেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী, বর্তমানে জেলবন্দি পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সেখানে এই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে তাঁদের কী লাভ হবে বুঝতে পারছেন না স্থানীয় গ্রামবাসী।
এই সৌর বিদ্যুৎ কি আশপাশে সবার বাড়িতে যাবে? এতে খরচা কত হবে? এ সব হাজারও প্রশ্ন তাঁদের। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী পিনাকী ঘোষের মতে, ‘‘এতে বিদ্যুতের খরচ কমবে, লোডশেডিংও হবে না। এলাকার মানুষের উপকারই হবে।’’ এই এলাকা থেকেই জেলাপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ হয়েছেন তৃণমূল নেতা চন্দন সাহা। তিনি বললেন, ‘‘সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এলাকার মানুষকে আরও বোঝাতে হবে। এটা যে উপকারী পরিবেশবান্ধব প্রকল্প সেটা অনেকে জানেন না। আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে সচেতন করতে।’’
ডব্লিউবিএসইডিসিএলের এক আধিকারিক জানালেন, ‘‘সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুবিধা স্থানীয় মানুষও পাবেন। এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে দেওয়া হবে, সেখান থেকে বন্টন হবে অন্যত্র।’’ স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর দাবি, ‘‘সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকেএলাকাবাসী সস্তায় বিদ্যুৎ পাবেন। পাশাপাশি অনুসারী শিল্পও গড়ে উঠবে। কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।’’
কিন্তু গাছ কাটা পড়ছে যে? ডব্লিউবিএসইডিসিএলের ওই আধিকারিকের জবাব, ‘‘বড় বড় গাছের ছায়ায় সূর্যের আলো ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই নিয়ম মেনে গাছ বা গাছের ডাল কাটা হয়েছে। সমপরিমাণ গাছ লাগানোও হচ্ছে।’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy