E-Paper

গণপিটুনিতে মৃত্যুর পরও অনুতপ্ত নয় গ্রাম

ঘটনার এক দিন পরেও ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এর জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। বরং তাঁরা মনে করছেন, সময়মতো উচিৎ শিক্ষা দেওয়া গিয়েছে অভিযুক্তকে।

সোমবার এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশ।

সোমবার এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।

গোপাল পাত্র

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ১০:০৬
Share
Save

আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত অপরাধীর বিচার ও শাস্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনার উপর আস্থা হারিয়ে সরাসরি নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়া! পুলিশ, প্রশাসন এবং সামগ্রিক ভাবে গোটা ‘সিস্টেম’-এর উপর অবিশ্বাসের জেরে অপরাধে অভিযুক্তকে তৎক্ষণাৎ নিজেরাই চরম শাস্তি দেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা ক্রমশ জনমানসে তীব্র হওয়ার প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায়। গত রবিবার পূর্ব মেদিনীপুরের এক গ্রামে এক অভিযুক্ত প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারার ঘটনায় আরও একবার সেই প্রবণতা প্রকট হয়েছে। ধর্ষণে বাধা পেয়ে গ্রামেরই এক মহিলাকে বিবস্ত্র করে মুখে কীটনাশক ঢেলে খুনের অভিযোগ উঠেছিল ওই প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধে।

ঘটনার এক দিন পরেও ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এর জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। বরং তাঁরা মনে করছেন, সময়মতো উচিৎ শিক্ষা দেওয়া গিয়েছে অভিযুক্তকে। পুলিশ-প্রশাসনের হাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হলে ঠিক রাজনৈতিক প্রভাব বা অর্থের প্রভাব খাটিয়ে অভিযুক্ত ছাড় পেয়ে যেত, ঠিক যেমন এত দিন একাধিক অপরাধ করে সে পেয়ে এসেছিল। অথবা তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়া এতটাই দীর্ঘায়িত হত যে, বিচারের অপেক্ষায় পেরিয়ে যেত মাসের পর মাস। ঠিক যেমন আর জি করের ঘটনায় হচ্ছে। গ্রামের বিভিন্ন বয়সের মানুষ একবাক্যে স্বীকার করছেন, পুলিশ-প্রশাসনে এমনিতেই তাঁরা আস্থা হারাচ্ছিলেন। তার উপর আর জি করের মতো মারাত্মক ঘটনায় এত প্রতিবাদ-আন্দোলন সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত প্রকৃত দোষীকে চিহ্নিত করতে তদন্তকারীরা ব্যর্থ হওয়ায় আইনি প্রক্রিয়ার উপর তাঁদের ভরসা তলানিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের এক প্রবীণার কথায়, ‘‘আর জি করের মতো ঘটনায় পুলিশ তথ্য প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আমাদের গ্রামে সেটা করা তো পুলিশের কাছে নস্যি। তার থেকে মানুষ অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছে, ঠিক করেছে।’’

সম্প্রতি একাধিক রাজনৈতিক নেতার মন্তব্যও যে জনমানসকে প্রভাবিত করেছে, সেটাও মানছেন সমাজতাত্ত্বিকদের অনেকে। যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এক নাবালিকার ধর্ষণ ও খুনের পর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আইন এনে ধর্ষকদের ‘এনকাউন্টার’ করার কথা বলেছেন। অনেকটা একই সুরে ধর্ষকদের গুলি করে মারার কথা বলেছেন তৃণমূলের সাংসদ-অভিনেতা দেব। জনপ্রিয় একাধিক হিন্দি সিনেমাতেও আইনি পথের বদলে পুলিশ ধর্ষকদের ‘এনকাউন্টার’ করছে, দেখানো হয়েছে। একাধিক রাজ্যে পুলিশি এনকাউন্টারে দাপুটে দুষ্কৃতী এবং বাহুবলীদের মৃত্যুর খবরও হামেশাই সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। গণপিটুনির পিছনে এই সবকিছুর একটা মিলিত প্রভাব রয়েছে বলে মত সমাজতাত্ত্বিকদের।

রবিবারই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী জানিয়েছিলেন, তিনি গণপিটুনি সমর্থন করেন না, তবে পুলিশ প্রশাসনের উপর থেকে আস্থা উঠে গিয়েছে বলেই জনগণ বাধ্য হচ্ছে আইন হাতে তুলে নিতে। একই কথা বলেছেন বিজেপির জেলা (কাঁথি) সভাপতি অরূপ দাস।

পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামে রবিবারের গণপিটুনির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল গ্রামের মহিলারা। পিছন থেকে যুবকদের সেই কাজে তাঁরা যেমন উৎসাহিত করেছেন তেমনই পুলিশের গাড়ি আটকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এর পিছনে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দীর্ঘদিন নিরন্তর বঞ্চিত থাকা, দীর্ঘদিন গ্রামের মহিলাদের উত্যক্ত করার পরেও অভিযুক্তের বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো ঘটনায় তাঁদের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে মহিলাদের ‘রাত দখল’ এর মতো আন্দোলনও ওই গ্রামের মহিলাদের রুখে দাঁড়াতে এবং পাল্টা মার দিতে সাহস জুগিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ওই এলাকায় শাসকদলের দুষ্কৃতীদের ভয়ে গ্রামবাসীর ত্রস্ত হয়ে থাকতে হত বলে অভিযোগ। অভিযুক্ত-মৃত শুকচাঁদ একসময় তৃণমূলের বাহুবলী কর্মী হওয়ার সুবাদে বহু অন্যায় করেও দিব্যি দাপটে দিন কাটিয়েছে। কৃষকদের সে চাষ করতে বাধা দিয়েছে, খাল পাড়ে সরকারি গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে, নিজের স্ত্রীকে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। তাও আইন তাকে ছুঁতে পারেনি। এ বার তাই এলাকাবাসীর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, ফের আইনের ফাঁক গলে পার পাবে শুকচাঁদ। সেই সুযোগ আর তাকে দিতে চাননি তাঁরা।

মনোচিকিৎসক অলোক পাত্রের কথায়, ‘‘মানুষের ন্যূনতম অধিকারগুলি যখন খর্ব করা হয় তখন তাদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা কাজ করতে থাকে। সেই হতাশা থেকে মানুষ ঠিক ভুল যাচাই করার তাৎক্ষণিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন গণপিটুনির মতো সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ তৈরি হয়।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

midnapore Rape victim

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।