সচেতনতা: হলদিয়া মহকুমা হাসপাতালে সাপের ছোবলের চিকিৎসা সংক্রান্ত পোস্টার। নিজস্ব চিত্র
কালাচের ছোবল বোঝা যায় না। আবার চন্দ্রবোড়ার ছোবলে প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। বলছেন চিকিৎসকেরা। সুতরাং চিকিৎসার জন্য সময় নষ্ট কোনও মতেই নয়। জেলায় সাপে কাটা রোগী এবং চিকিৎসার হাল কী তার খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রতি বছর গড়ে ৪০০-৪৫০ জন সাপের ছোবল খান। জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা জানাচ্ছেন, ২০১৬ সালে ৩০৬ জনকে সাপে ছোবল দিয়েছিল। ২০১৫ সালে ৬৯৮ জন সাপের ছোবলের শিকার হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ৬২১ জনকে সাপে ছোবল দেয়। প্রতি বছর গড়ে ৩-৪ জনের মৃত্যুও হয়। জেলায় সবথেকে বেশি সাপে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে কেশপুর এবং ডেবরায়। গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, ঘাটালের মতো এলাকাতেও সাপের উপদ্রব রয়েছে। হাসপাতালগুলিতে সাপে কামড়ানোর প্রতিষেধক মজুত রয়েছে বলেই জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ প্রধানেরও দাবি, ‘‘এখন হাসপাতালগুলিতে সাপে কামড়ানোর প্রতিষেধকের অভাব নেই। প্রতিষেধক পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে।’’ সাপে কামড়ানোর পরে কী করা উচিত, তা নিয়ে নির্দেশিকা রয়েছে। বেশিরভাগ হাসপাতালে তা টাঙানোও রয়েছে।’’
রবীন্দ্রনাথবাবুর দাবি, ‘‘সাপের কামড়ে মৃত্যু আটকাতে জেলায় সব রকম পদক্ষেপই করা হয়েছে। তাহলে কেন মৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না? জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘বিষধর সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে পরিমাণ মতো ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগী বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায়, সাপে কামড়ানো রোগীকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন বিষ তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সাপে কাটার পরে অনেক ক্ষেত্রে কুসংস্কারবশত ওঝা, গুণিনের কাছে নিয়ে সময় নষ্ট করেন রোগী বা তাঁর পরিবারের লোকেরা।’’ ডেবরার এক স্বাস্থ্যকর্মীর স্বীকারোক্তি, ‘‘এলাকার ৭০-৮০ শতাংশ সাপে কামড়ানো রোগী চিকিৎসা করাতে প্রথমে ওঝার কাছেই যান। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় স্থানীয় হাসপাতালে ছুটে আসেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এর থেকেই স্পষ্ট, সর্বত্র মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার এখনও ঘোচেনি।’’ চন্দ্রবোড়া, গোখরো, কালাচ বা কেউটে কামড়ানোর পরে কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে পরিমাণমাফিক প্রতিষেধক দিয়েও বাঁচানো যায় না। জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘অযথা সময় নষ্ট করলেই বিপদ। চন্দ্রবোড়ার মতো সাপের কামড়ে প্রতি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, সময় নষ্ট হলে তা মারাত্মক হতে পারে। এক মিনিট নষ্ট হলে কিডনি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ বেড়ে যায়।’’
ঝাড়গ্রামের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। গত এক মাসে ঝাড়গ্রাম জেলায় সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় রয়েছে ২৫টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছ’টি গ্রামীণ হাসপাতাল, তিনটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। এর মধ্যে ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এবং নয়াগ্রাম ও গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকে আরও দু’টি সুপার স্পেশ্যালিটি। জেলার সিএমওএইচ অশ্বিনীকুমার মাঝি বলেন, ‘‘সর্পাঘাতের রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক প্রতিটি হাসপাতালে মজুত রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে রোগীদের দেরিতে নিয়ে আসার কারণে তখন আর কিছুই করার থাকে না। তবে সঙ্কটজনক রোগীরা সুপার স্পেশ্যালিটি ভর্তি হয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন এমন বহু নজির রয়েছে।’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, স্বাস্থ্য দফতরের নিরন্তর সচেতনতা প্রচারের ফলে এখন সাপে কাটা রোগীদের ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, সর্পাঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ড থেকেও রোগীরা ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সুপার মলয় আদক বলেন, ‘‘হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে সাপের বিষের প্রতিষেধক রয়েছে। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় সাফল্যের হার আমাদের হাসপাতালে খুবই ভাল। সঙ্কটজনক রোগীদেরও সুস্থ করে আমরা বাড়ি পাঠাতে পেরেছি।’’ তবে স্বাস্থ্য দফতর জানাচ্ছে, কালাচের মতো কিছু সাপ আছে, যেগুলি কামড়ালে সহজে বোঝা যায় না। তাই সচেতন থাকতে হবে। মশারি টাঙিয়ে ঘুমোতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। বাড়িতে ইঁদুর, ব্যাঙ যাতে না ঢোকে সেটা দেখতে হবে। সাপে কামড়ানো রোগীর উপসর্গ সব সময় বোঝা যায় না। তাই সন্দেহ হলেই দেরি না করে রোগীকে নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিছুদিন আগে বেলিয়াবেড়ার শিবানন্দপুর গ্রামের অসুস্থ এক শিশুকে অত্যন্ত সঙ্কটজনক অবস্থায় ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। শরীরে কোথাও সাপের ছোবলের চিহ্ন ছিল না। শেষ পর্যন্ত উপসর্গ দেখে হাসপাতালের দুই শিশু বিশেষজ্ঞ সাপের বিষের প্রতিষেধক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়।
ঘাটাল মহকুমার সব স্তরের হাসপাতালগুলোতে সাপে কাটার প্রতিষেধক মজুত রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ঘাটাল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে অভাব নেই প্রতিষেধকের। তবে প্রাথমিক স্তরের হাসপাতালগুলিতে সাপে কাটা রোগীকেই দেড় ঘণ্টা-দু’ঘন্টা পেরিয়ে গ্রামীণ কিংবা মহকুমা কিংবা হাসপাতালে ছুটতে হয়। তাতে সমস্যা বাড়ে। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রোগীকে ইঞ্জেকশন দিলে অনেক সময় নানা সমস্যা শুরু হয়। এদিকে এই সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে নেই। চিকিৎসকও থাকেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স বা হাসপাতালে কর্মীরা ওই ইঞ্জেকশন দেন। ফলে রোগীকে রেফার করতে হয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, ঘাটাল এমনিতেই বন্যাপ্রবণ। সাপের উপদ্রবও বেশি। হাসপাতালগুলিতে রোজ নিয়ম করেই সাপে কাটার রোগীদের ভিড় বাড়ছে।
এগরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে সাপের বিষের প্রতিষেধক পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে। কোনও সাপে কাটা রোগীকে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে ফেরানো হয় না বলে হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে।
তথ্য সহায়তা: কিংশুক গুপ্ত, গোপাল পাত্র, অভিজিৎ চক্রবর্তী, বরুণ দে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy