পরিবর্তনের ঝড়ে ‘গড়’ রক্ষা হয়েছিল ঠিকই। তারপর থেকে পিদিম নিভেছে একের পর এক দলীয় কার্যালয়ে।
পালাবদলের পর গত সাড়ে চার বছরেও দলের সব কার্যালয় খুলতে পারেনি সিপিএম। দলের শাখা অফিসগুলির বেশিরভাগ বন্ধ। টিমটিম করে জ্বলছে গড়বেতা জোনাল কমিটির অফিস। হামলার ভয়ে এক সময়ের দলের একনিষ্ঠ কর্মী-সমর্থকেরাও প্রকাশ্যে দলের হয়ে প্রচারে নামতে ভয় পাচ্ছেন।
এক সিপিএম নেতার কথায়, “ঘরছাড়া হতে কার ভাল লাগে বলুন। প্রতিনিয়ত অশান্তি। এখানে এক দলীয় শাসন চলছে। এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কী দলের হয়ে প্রচার করা যায়!” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এই হল পরিবর্তন। একসময় বামেদের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সরব হত বিরোধীরা। আর এখন উলটপুরাণ। তৃণমূলকে দোষারোপের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে বাম নেতাদের গলায়।’’ ওই বাম নেতাও বলছেন, ‘‘যদি মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারে, তাহলে এত সহজে গড়বেতার ‘গড়’ হাতছাড়া হবে না। মানুষ সুযোগ পেলে বামপন্থীদেরই নিয়ে আসবে।”
এই আশাতেই বুক বেঁধে এগিয়ে চলেছেন গড়বেতার সিপিএম প্রার্থী সরফরাজ খান। গড়বেতার একসময়ের ‘দাপুটে’ নেতা দাসেরবাঁধ কঙ্কাল কাণ্ডে অভিযুক্ত সুশান্ত ঘোষকে এ বার প্রার্থী করেনি সিপিএম। দলের এক সূত্রে খবর, বর্তমানে দলে অনেকটাই ব্যাকফুটে সুশান্তবাবুর শাগরেদ তপন ঘোষ ও সুকুর আলিও। দলে দীপক সরকারের জমানার অবসানের পর অন্তরালে চলে গিয়েছেন এই নেতারাও। তাই সুশান্তবাবুকে গড়বেতায় প্রার্থী করতে চেয়ে অনেক দরবার করেও সফল হননি তপন-সুকুররা। সরফরাজ গড়বেতা কলেজের ছাত্র। কলেজে এসএফআইয়ের হাত ধরেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জন্যই সরফরাজের উপর আস্থা রেখেছে দল।’’
প্রার্থী হননি তো কি হয়েছে, দলের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতে গত মাসে গড়বেতায় দলের জোনাল কার্যালয়ে বৈঠক করেন সুশান্তবাবু। যদিও তারপরে দলের প্রচারে আর সে ভাবে তাঁকে দেখা যায়নি। তাই লড়াইটা এ বার তুলনায় কঠিন, তা একবাক্যে মানছেন দলের সব নেতা-কর্মীই। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘সুশান্তদা থাকলে মনে জোর পাওয়া যায়। অস্বীকার করতে বাধা নেই, এ বার আমরা অনেকটা পিছিয়ে থেকেই লড়াইয়ে নেমেছি। তবে আমরা সরফরাজকে জেতাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি।’’
তবে ছোট আঙারিয়া, দাসেরবাঁধ কঙ্কাল কাণ্ড নিয়ে কিছুটা হলেও অস্বস্তি রয়েছে। তাই গড়বেতায় প্রচার করতে এসে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমকেও বলতে হচ্ছে, “আমরা বলছি না, ৩৪ বছরে আমরা সব শুধুই ভাল করেছি। অন্যায়ও কিছু হয়েছে। ভুলত্রুটিও হয়েছে। সরকার চালাতে গিয়ে, সংগঠন চালাতে গিয়ে, আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের আচারে ব্যবহারে কথায় বার্তায়।” তাঁর দাবি, সে সব কাটিয়ে উঠে নিজেদের সংশোধন করেছে সিপিএম। কিন্তু তৃণমূল তা করছে না। সারদা থেকে নারদ, সিন্ডিকেট রাজ – এ সব মানুষ দেখতে পাচ্ছেন টিভি খুললেই। গড়বেতায় তৃণমূলের পথেও কাঁটা অনেক। দলের এক সূত্রে খবর, পাথর খাদান নিয়ে গোষ্ঠীকোন্দল, এলাকা দখলের লড়াই নিয়ে অস্বস্তিতে শাসকেরাও।
পরিসংখ্যান অবশ্য অন্য কথা বলছে। এক সময় যে গড়বেতায় লক্ষাধিক ভোটে জয় পেত সিপিএম, এখন সেই গড়বেতার ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতই তৃণমূলের দখলে। পঞ্চায়েত সমিতিও তাঁদেরই দখলে রয়েছে। ২০১১ সালে এখান থেকেই জয়ী হয়েছিলেন সিপিএমের বিদায়ী বিধায়ক সুশান্তবাবু। কিন্তু জয়ের ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজারের কাছাকাছি। গত বিধানসভা ভোটে সুশান্তবাবু পেয়েছিলেন ৮৬০৪৭টি ভোট। ৫২.০৩ শতাংশ ভোট ছিল বামেদের দখলে। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রার্থী হেমা চৌবে পেয়েছিলেন ৭০৯৭৭টি। জোটের প্রার্থী ৪৩.০৮ শতাংশ ভোট পান। বিজেপি পেয়েছিল ৭৭৩৩টি ভোট।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে চিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টে যায়। বামেদের ভোট শতাংশ প্রায় ৩২ শতাংশ কমে হয় ২০.০৩। আর তৃণমূলের দখলে ছিল ৬৪.১৫ শতাংশ ভোট। লোকসভা নির্বাচনে গড়বেতা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ১,১২,৯২৬টি ভোট পান। বিজেপিও ৮.৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কংগ্রেসের দখলে ছিল ৩.৩০ শতাংশ ভোট।
যদিও অঙ্কের হিসেবকে গুরুত্ব দিতে নারাজ সিপিএম প্রার্থী সরফরাজ খান। তিনি বলছেন, ‘‘২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তো ওরা মানুষকে ভোটই দিতে দেয়নি। তাহলে ভোট পাব কী করে?” সন্ত্রাসের দাপটে আগে অনেকেই ঘরছাড়া ছিলেন বলে অভিযোগ। এখন অবশ্য অনেকেই ঘরে ফিরেছে। দলের সংগঠনকে অনেকটা চাঙ্গা করা গিয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের আবহে এটাই যা স্বস্তি দিচ্ছে বাম নেতাদের। যদিও তৃণমূল প্রার্থী আশিস চক্রবর্তীর কথায়, “সিপিএম আছে কোথায়! মানুষ খুন, বাড়ি লুঠে অভিযুক্ত গুটিকয় নেতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ আর ওদের পাশেই নেই।’’ তিনি বলছেন, ‘‘মানুষ আর খুন, সন্ত্রাস চান না। শান্তি চান। আমাদের ছোটখাটো মিছিলেও মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে, সেটাই বুঝতে পারছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy