ফাইল চিত্র।
প্রস্তাব দীর্ঘদিনের। সংকল্পে দৃঢ় রাজ্য সরকারও। বুধবার রাজ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন শুরু হতেই তাই আশাবাদী হয়েছেন তাজপুরবাসীও। তাঁদের মনে প্রশ্ন— এ বারের সম্মেলনে কি তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি নিয়ে কোনও শিল্পপতির বিনিয়োগ করবে! হবে কি কোনও চুক্তি।
সাম্প্রতিক কালে আদানি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা একাধিকবার রামনগরের তাজপুরে এসে সরাসরি প্রস্তাবিত বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেছেন। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্য সম্মেলনে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজ্য সরকারের বন্দর নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা প্রবল রয়েছে বলে আশা জেলা প্রশাসনেরও। বুধবার দিঘায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পে উপভোক্তাদের টাকা পাঠানোর সূচনা অনুষ্ঠানে গিয়ে সে ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেছেন পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী। তিনি বলেছেন, ‘‘তাজপুরের দ্রুত সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হবে।’’ সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে তাজপুরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হবে বলে তাঁর আশা। তাই এখন শুধু অপেক্ষা। দেখার, বাণিজ্য সম্মেলন চলাকালীন তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের দায়িত্ব কোনও সংস্থার হাতে রাজ্য সরকার তুলে দেয় কি না।
এ দিন কলকাতার ওই বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে এসে আগামী ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছেন আদানি গোষ্ঠী কর্ণধার গৌতম আদানি। তবে তাঁকে তাজপুর বন্দর নিয়ে আলাদা করে কোনও মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। যদিও মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও মঞ্চে জানিয়েছেন, তাজপুরে দ্রুত বন্ধ তৈরি করা হবে। সে বিষয়ে সমস্ত প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে দিঘার শিল্প সম্মেলন থেকে তাজপুর বন্দরের প্রকল্প অফিস উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের হাতে তখন তাজপুর বন্দরের ২৬ শতাংশ শেয়ার এবং কলকাতা বন্দরের হাতে বাকি ৭৪ শতাংশ শেয়ার ছিল। পরে অবশ্য একক ভাবেই তাজপুরে বন্দর গড়ে তোলার বলে সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। পরপর দু'দফায় বন্দর গড়তে চেয়ে আগ্রহী সংস্থার কাছ থেকে দরপত্র চায় তারা। ওই আগ্রহপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ৩১ জানুয়ারি। প্রশাসন সূত্রের খবর, অনেক সংস্থা তাজপুরের বন্দর গড়তে চেয়ে ওই সময়ের মধ্যে আগ্রহ পত্র জমা দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রের খবর, মৎস্যজীবীদের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভর তাজপুরের অর্থনীতি। বন্দর হলে এলাকার অর্থনীতি ভাল হবে আশাবাদী সেখানকার হোটেল মালিকদের সংগঠন। সংগঠনের সম্পাদক শ্যামল কুমার দাস বলেন, ‘‘তাজপুরের বন্দর তৈরির কাজ শুরু হলে প্রচুর মানুষের আনাগোনা হবে। তাতে এলাকার অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। তবে কয়েক বছর ধরে এলাকায় সমস্ত জমির মিউটেশন এবং কনভারশন বন্ধ রয়েছে। দ্রুত সেই প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।’’ একই রকমভাবে আশার আলো দেখছেন স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মৎস্য মন্ত্রী অখিল গিরি। তিনিও বলছেন, ‘‘তাজপুরের বন্দর গড়তে চেয়ে অনেক সংস্থা আগ্রহ দেখিয়েছে বলে শুনেছি। রাজ্যের শিল্প সম্মেলনে এ ব্যাপারে যে কোনও একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। তারা লগ্নির কথা ঘোষণা করবে বলে আশাবাদী।’’
তাজপুরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে রাজ্যের শাসক দল, এলাকাবাসী আশায় বুক বাঁধলেও বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কলকাতা বন্দরের নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ সংস্থা এইচওডব্লিউই-এর রিপোর্ট বলছে, তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দরের ভবিষ্যৎ রয়েছে। কিন্তু তা তেমন ‘উজ্জ্বল’ নয়। কলকাতা বন্দরের খবর, তাজপুর বন্দর গড়তে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। বন্দর তৈরি হলেও ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে ওড়িশা উপকূলে থাকা টাটা গোষ্ঠীর ১৮ মিটার নাব্যতা যুক্ত সুবর্ণরেখা বন্দরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে তাজপুরকে। এছাড়া, ১২ হাজার কোটি লগ্নি ছাড়াও গভীর সমুদ্র বন্দরের ২৫ কিলোমিটার শিপিং চ্যানেলের ড্রেজিংয়ের বার্ষিক খরচও আকাশছোঁয়া হবে বলে ২০১৯ সালে জানিয়েছিল ওই বিশেষজ্ঞ সংস্থা। তার পরেই ওই সংস্থার প্রি-ফিজিবিলিটি রিপোর্ট নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেননি বন্দরের কর্তারা।
বন্দর সূত্রের খবর, উপদেষ্টা সংস্থা তাজপুরে কেবলমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ‘ক্লোজ ভায়াবিলিটি’র কথাই বলেছে। সে জন্য দু’টি উপায়। প্রথমত, ২৫ কিলোমিটার শিপিং চ্যানেল তৈরি করে সাগর তীরে বন্দর নির্মাণ। দ্বিতীয়ত, জলের মধ্যে ১০ কিলোমিটার রেল-রাস্তা তৈরি করে সমুদ্রের মধ্যে বন্দর নির্মাণ করা। যদি শিপিং চ্যানেল তৈরি করতে হয়, তা হলে প্রতি বছর ড্রেজিংয়ের খরচও ঘাড়ে চাপবে। এই দুই শর্ত মানা হলে ১৬-১৭ মিটার নাব্যতার বন্দর তৈরি সম্ভব তাজপুরে। তবে তা লাভজনক হতে বেশ কয়েক বছর কেটে যাবে।
কেন গভীর সমুদ্র বন্দরই একমাত্র বিকল্প, তা-ও ব্যাখ্যা করেছিল উপদেষ্টা সংস্থা। তাদের মতে, হলদিয়া বন্দরের বর্তমান নাব্যতা ৮.৫ মিটার। যদি তাজপুরে ৯-১০ মিটার নাব্যতার বন্দর হয়, তা হলে কলকাতা-হলদিয়ার পণ্যই সেখানে যাবে। জাহাজিরা এখন কেপসাইজ (দেড় লক্ষ টন পণ্যবাহী) জাহাজ এনে পণ্য খালাসে আগ্রহী। পারাদ্বীপ বন্দরে সেই ধরনের জাহাজ আসে। তার পর ছোট জাহাজে পণ্য আসে হলদিয়া ও কলকাতায়। সুবর্ণরেখাতেও সে রকম জাহাজই আসবে। ফলে তাজপুরকে সফল হতে হলে অন্তত ১৮ মিটার নাব্যতার বন্দর চায়। তার জন্য যে টাকা নিয়োগ করতে হবে, তা কতদিনে উঠে আসবে সংশয় রয়েছে তাতেও। উপদেষ্টা সংস্থার প্রশ্ন, গভীর বন্দর নির্মাণের বিপুল খরচ কোথা থেকে আসবে? রেল-রাস্তা এবং বন্দরের পণ্য খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সমস্যা কী ভাবে মিটবে?
বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে কটাক্ষ করছে বিরোধীরা। বিজেপি নেতা তথা গত বিধানসভা ভোটের রামনগর কেন্দ্র থেকে পরাজিত বিজেপি প্রার্থী স্বদেশ নায়ক বলেন, ‘‘তাজপুরে বন্দর হবে বলে শুনেছি। আদানি গোষ্ঠী এসে ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু কবে কোথায় হবে কিছুই জানি না। জমি অধিগ্রহণের কাজটুকুই দেখা যায়নি।’’ একই রকম ভাবে সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য আশিস প্রামাণিক বলেন, ‘‘তাজপুরে বন্দর প্রকল্পকে স্বাগত। তবে যেখানে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার উভয়ে মিলে প্রকল্প গড়ে তুলতে পারছে না, সে ক্ষেত্রে ঋণে জর্জরিত রাজ্য সরকারের পক্ষে কীভাবে বন্দর গড়ে তোলা সম্ভব হবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy