অঙ্কনে: অমিতাভ চন্দ্র
পাখিগুলা আমাদের আগে ঘুমাই যায়। সেই সাঁজবেলায়। সূর্য শালগাছগুলার মাথার উপর দিয়ে নামতে নামতে লাল হতে হতে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যায়। আর পাখিগুলার ডাকও কমতে কমতে একেবারে থেমে যায়। আমরা তো তার আরও কিছুটা পরে ঘুমাই। কিন্তু পাখিরা আবার যখন ঘুম থেকে উঠে পড়ে আমরাও জেগে যাই। চারপাশে শুনতে পাওয়া পাখির ডাকই আমাদের কাছে জীবন্ত কিছুর আওয়াজ সব সময় শুনতে পাওয়া। আরও কিছুর আওয়াজ আছে। বাড়ির সামনে মোরামের রাস্তা দিয়ে কড়মড়িয়ে চলে যাওয়া সাইকেল। দিনে দু’তিনবার হয়তো শোনা যায়। মাঝে মাঝে বাইকের শব্দও পাই। তখন কড়মড় করা আওয়াজটা একটু পাল্টে যায়।
দেখতে পাই গাড়িও। ঘুরতে আসা বাবুদের গাড়ি। এই তোমাদের মতো। তারা আমাদের ছবি তোলে। বাড়ির সামনে ডাঁই করা বাবুই দড়িতেও ওদের নজর। ছবি তোলে এসবেরও। যেন কত দামী জিনিস দেখতে পেয়েছে। তবে এত জঙ্গলের রাস্তায় খুব বেশি ঘুরতে আসে না লোকজন। সেটাই বাঁচোয়া। না হলে আমাদের কাজ থামিয়ে ওদের নানা কথার জবাব দিতে হত। আমাদের বাড়িও ভাল লাগে ওদের। তকতকা বাড়ির ছবি তোলে বাবুরা।
এই জায়গাটার নাম কী? আমার নাম? স্বামীর নাম? তোমরাও তো অনেক কথা জানতে চাইছ দেখছি! জায়গাটা ঝাড়গ্রামের আমঝরনা থেকে ঝাড়খণ্ডের ঝাঁটিঝরনার দিকে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে তার কোনও একটা জায়গায় ধরে নাও। স্বামীর নাম বাবলু সিং, আমি মংলা সিং (নাম ও পদবি পরিবর্তিত)। বাবুই ঘাসের দড়ি বুনি। স্বামী সেগুলো সাইকেলের পিছনে বেঁধে বেলপাহাড়ি নিয়ে যায়। ওখানকার বাজারে বেচে আসে। ফেরার সময়ে সংসারের টুকিটাকি জিনিস কিনে আনে। আমরা শালপাতাও তুলি জঙ্গল থেকে। স্বামী কুরকুট (পিঁপড়ের ডিম) ঝেড়ে আনে মাঝে মাঝে। তোমরা বাঁকুড়া গিয়েছ? পুরুলিয়া? এই তো ঝাড়গ্রামের একেবারে ল্যাজায় বাঁকুড়া। ঝিলিমিলি, রানিবাঁধ পড়ে। সেখান থেকে আর কিছুটা গেলে পুরুলিয়া। কুইলাপাল, দুয়ারসিনি। লোকে তো দুয়ারসিনি ঘুরতে যায় গো! এই জায়গাগুলোয় গেলে দেখবে আমাদের মতো কত মানুষ আছে। শালপাতা তোলে, বাবুই ঘাসের দড়ি বোনে, ছাগল চরায়। আমাদের মতো অনেক জঙ্গলবাসীর জীবন।
পাখির ডাকের সঙ্গে জেগে উঠি কেন? অত সকালে উঠে কী করি? কত কাজ থাকে। আমার একটা মেয়ে, একটা ছেলে। মেয়েটা বড়। বছর চারেকের। ছেলেটা ছোট। এক বছর পার করেছে। আমরা দু’জন যখন উঠি তখন বাচ্চাগুলো ঘুমায়। অত সকালে উঠে কী করবে? সকালে উঠে ঘরের কাজ করি আগে। আমাদের মাটির বাড়িটা ঝকঝকে, তকতকে বলছিলে না? অনেক খাটতে হয় বাড়িটাকে সুন্দর রাখতে। উঠোনেও কোনও ময়লা পাবে না। বাড়ির কাজের পরে জঙ্গল থেকে জ্বালানি আনতে যাই। কোনও দিন আমি যাই। কোনও দিন স্বামী যায়। জল আনি। আমি যতক্ষণ ঘরের কাজ করি স্বামী ততক্ষণ বাবুই ঘাসের দড়ি পাকায়। আমাদের হাতে পাকাতে হয় দড়ি। কারও কারও যন্ত্র আছে। তা দিয়ে দড়ি পাকায়। আমরা ওই দড়ি পাকানোর যন্ত্র কিনতে পারিনি। তাই দু’জনকেই কাজ করতে হয়।
কাজ শেষ হতে না হতেই ছেলে মেয়েগুলো উঠে পড়ে। ওরা হাত মুখ ধুলে খেতে দিই। আমরাও খাই। খাওয়ার পরে স্বামী জঙ্গলে যায়। বাবুই ঘাস কাটতে। কোনওদিন আগে কেটে রেখে শুকনো হতে দেওয়া বাবুই ঘাসগুলো নিয়ে আসে। তার পর দড়ি পাকানোর কাজ শুরু হয়। দেখতেই পাচ্ছ আশেপাশে কোনও বাড়ি নেই। আমাদের বাড়িটাই শুধু আছে। আরও কিছুটা গেলে দু’চারটে বাড়ি পাবে। স্বামী যেদিন বাবুই দড়ি নিয়ে সকালে বেলপাহাড়ি চলে যায় সেদিন আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে একাই থাকি। ছাগলের পাল নিয়ে জঙ্গলে যায় ওপাড়ার একটা দু’টো বাচ্চা। উঠোনে বসে কাজের ফাঁকে ওদের সঙ্গে একটা দু’টো কথা বলি। সন্ধের আগে স্বামী বেলপাহাড়ি থেকে ফেরে। তার কিছুক্ষণ পরে সর্দার ছাগলের গলার ঘন্টির ঠুনঠুন শব্দ শোনা যায়। ছেলেগুলো ঘরে ফেরে। পাখিগুলোর ডাক কমতে থাকে। চুলো জ্বলে। রাতের রান্না করি। খেয়েদেয়ে গুছিয়ে ঘুম। সকাল থেকে ফের শুরু খাটুনি।
দুর্গাপুজো তেমন দেখা হয় না। দূরে দু’একটা পুজো হয়। ঠাকুর দেখতে হলে দিনে বেরোতে হবে। সন্ধ্যের পরে জঙ্গলের রাস্তায় অত দূর যেতে পারি না। বেশি মজা হয় মকর পরবে। জঙ্গলমহলটাই আনন্দ করে। দুর্গাপুজোয় জঙ্গলে এক ছাতু হয়। কাড়ান ছাতু। দুর্গা ছাতুও বলি। দারুণ খেতে। শুনেছি, বাবুদেরও পছন্দ।
অনুলিখন: দীপক দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy