Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Mother Language

Mother Language: মাতৃভাষার টানে পড়াশোনায় ফিরছে স্কুলছুটরা

পাঁশকড়ার হাউর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আমদানে উপজাতি হো সম্প্রদায়ভুক্ত অন্তত ৮০টি পরিবার বাস করে।

ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

দিগন্ত মান্না
পাঁশকুড়া শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:২৬
Share: Save:

হাতিয়ার ভাষা। তা দিয়েই করোনা কালে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে দেওয়া হো সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন পাঁশকুড়ার কয়েকজন শিক্ষক। ইতিমধ্যে তাঁরা তৈরি করছেন হো ভাষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে বারাং চিতি লিপিতে চলে প্রশিক্ষণ।

পাঁশকড়ার হাউর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আমদানে উপজাতি হো সম্প্রদায়ভুক্ত অন্তত ৮০টি পরিবার বাস করে। অধিকাংশরেই পেশা দিনমজুরি। করোনার জন্য ২০২০ সালে লকডাউন শুরু হলে স্কুল বন্ধ হয়। সে সময় বাড়ির ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ করে বাইরে কাজ শেখাতে পাঠিয়ে দিতে শুরু করেন ওই সব পরিবারের অভিভাবকেরা। বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের। সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ওই সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের পড়াশোনার মধ্যে ফেরাতে উদ্যোগী হন কুমরপুর হটেশ্বর হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক রূপেশ কুমার সামন্ত। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন জাড়দই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক গুরুপদ পূর্তি এবং গুরুদাস সিরকা নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী।

কিন্তু অর্থ উপার্জনের পথে চলে যাওয়া পড়ুয়াদের কী ভাবে স্কুলে ফেরানোর কথা বোঝাবেন, সে বিষয়টি ভাবায় রূপেশদের। প্রাথমিক ভাবে তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝানো শুরু করেন। পরে হো সম্প্রদায়ের ভাষাকেই তাঁরা হাতিয়ার করতে চান। সকলের মধ্যে ওই ভাষা ছড়িয়ে দিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার কথা ভাবেন। এর পরেই হাউরের আমদানে স্থানীয় একটি ক্লাবের সহযোগিতায় বছর দেড়েক আগে শুরু হয় রূপেশদের হো ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যার নাম ‘হো হায়াম ওয়ার রাকাব মণ্ড’ ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

রূপেশদের উৎসাহ দেখে এগিয়ে আসেন কার্তিক বার্জ নামে স্থানীয় এক প্রশিক্ষক। তিনি বিনামূল্যে হো সম্প্রদায়ের ভাষার লিপি বারাং চিতিতে পড়ুয়াদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন ওই কেন্দ্রে। পাশাপাশি স্কুলছুটদের বাড়িতে গিয়ে রূপেশের নেতৃত্বে আরও বেশি করে প্রচার চালানো হয়। আর এর ফলও মেলে হাতেনাতে। বাইরে কাজ করতে চলে যাওয়া অনেক পড়ুয়াই ভাষা শিক্ষার টানে আবার এলাকায় ফিরে আসে। কমে আসে নাবালিকা বিবাহও। রূপেশ বলেন, ‘‘পাঁশকুড়া এলাকায় অন্তত দু’হাজার মানুষ হো ভাষায় কথা বলেন। অথচ এই ভাষার কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাই ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র চালু করে একদিকে যেমন স্কুলছুটের সংখ্যা কমানো গিয়েছে, তেমনি হারিয়ে যাওয়া বারাং চিতি লিপি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গিয়েছে।’’

রূপেশ জানাচ্ছেন, বর্তমানে সপ্তাহে একদিন ক্লাস হয়। সেখানে হো ভাষার পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরেজি ভাষারও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পড়ুয়াদের বোঝানো হয় স্কুলে যাওয়ার গুরুত্ব। হো সম্প্রদায়ভুক্ত সাত থেকে ২০ বছর বয়সের অন্তত ৪০ জন পড়ুয়া রূপেশের ভাষাশিক্ষা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রী। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী দুর্গা সিংয়ের কথায়, ‘‘স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাড়ির সামনে ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চালু হওয়ায় বাবা আমাকে ভর্তি করে দেন। এখানে হো ভাষার পাশাপাশি স্কুলের বিষয়গুলিও পড়ানো হয়। তাই আবার পড়াশোনা শুরু করেছি।’’ দিনু সিং নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘দু'বছর আগে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভেবেছিলাম মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব। পরে কয়েকজন শিক্ষক এসে বললেন এলাকায় হো ভাষা শেখানো হবে। আমরা নিজেদের মধ্যে এই ভাষাতেই কথা বলি। তাই ওখানে ভর্তি করায়। মেয়ে স্কুলের পড়াও চালিয়ে যাচ্ছে।’’

উল্লেখ্য, হো সম্প্রয়াদের ভাষার লিপি বারাং চিতি আবিষ্কার করেন ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূমের বাসিন্দা লাকো বডরা। এটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর মুন্ডা ভাষা। হো, মুন্ডা, কোল ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকজন হো ভাষায় কথা বলেন। ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন’ হো ভাষাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে। পড়শি রাজ্য ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে এই ভাষার সরকারি স্বীকৃতি রয়েছে। তবে এ রাজ্যে সাঁওতালী ভাষার স্বীকৃতি মিললেও বারাং চিতির স্বীকৃতি মেলেনি। তাই রূপেশার বারাং চিতির স্বীকৃতিরও আর্জি জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অলচিকির মতো রাজ্য সরকার বারাং চিতিকেও স্বীকৃতি দিক। তা-হলে এই সম্প্রদায়ের বহু স্কুলছুটেরা স্কুলে ফিরবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Mother Language East Midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy