Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

‘কিছু হবে না’, ছবি তোলার এই নাছোড় মানসিকতা ডেকে আনছে বিপদ

সকলেই আলোকচিত্রী এখন। মোবাইলেও মেলে হাই রেজ্যুলেশনের ছবি। ফলে তাঁরা হামলে পড়েন প্রকৃতি, পশু-পাখির উপরে। কখনও নিজের বিপদ ডেকে আনা স্টান্টে। ফল হয় মারাত্মক। নিয়ম না মেনে ফটোগ্রাফির বিপদের খোঁজে আনন্দবাজারসম্প্রতি ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইলে হাতির ছবি তুলতে গিয়ে আশিস শীট নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়। সেদিন দু’বার হাতির দল তাড়া করেছিল ছবি তোলার দলকে। কিন্তু হুলাপার্টির সদস্যরা নিষেধ করা সত্ত্বেও আশিস জঙ্গলে ঢুকেছিলেন ছবি তুলতে।

বেপরোয়া: প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিষেধ করেছে। তবুও গনগনিতে খাদের কিনারায় নিজস্বী-প্রিয়। নিজস্ব চিত্র

বেপরোয়া: প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিষেধ করেছে। তবুও গনগনিতে খাদের কিনারায় নিজস্বী-প্রিয়। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৯
Share: Save:

উদাহরণ দেওয়া যায় বহু। সম্প্রতি দার্জিলিংয়ে টয়ট্রেন থেকে ঝুঁকে ভিডিয়ো তুলছিলেন এক যুবক। কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে মারা যান। বেপরোয়া ফটোগ্রাফিতে বারবার প্রাণ যাওয়ায় একসময়ে কেন্দ্রীয় পর্যটনমন্ত্রক ‘নিজস্বী নিষিদ্ধ এলাকা’ চিহ্নিত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাতে কি কোনও কাজ হয়েছে? বেশি দূর যেতে হবে না। পশ্চিম মেদিনীপুরের পর্যটনস্থল গনগনিতে ভূমিক্ষয়ের ফলে তৈরি টিলাগুলোর কিনারায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ঝোঁক দেখা যায় পর্যটকদের। ঘটেছে দুর্ঘটনাও। সাবধান করতে জেলা পুলিশ বিজ্ঞপ্তি-বোর্ড টাঙিয়েছে। তবুও খাদের ধারে পা ঝুলিয়ে ছবি তোলেন পর্যটকেরা।

সম্প্রতি ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইলে হাতির ছবি তুলতে গিয়ে আশিস শীট নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়। সেদিন দু’বার হাতির দল তাড়া করেছিল ছবি তোলার দলকে। কিন্তু হুলাপার্টির সদস্যরা নিষেধ করা সত্ত্বেও আশিস জঙ্গলে ঢুকেছিলেন ছবি তুলতে। খবরে প্রকাশ, ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তোলার পরই একটি হাতি তাড়া করে। তার শুঁড়ের ধাক্কায় আশিস ছিটকে পড়ে মারা যান। আশিসের মৃত্যু কতকগুলো প্রশ্ন তুলে দেয়। কারণ তিনি পাখির ছবি তুলতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে ফেসবুকে পরিচিতরা লিখেছিলেন, ‘এথিক্স’ মেনেই ছবি তুলতেন আশিস। কেউ আওয়াজ করলে, পাখি তাড়ালে রেগে যেতেন। কিন্তু হাতির ছবি তুলতে কেন এতটা বেপরোয়া হলেন তা পরিচিতেরা বুঝতে পারছেন না। আশিস এই প্রথম হাতির ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলেন।

অর্থাৎ পাখির ছবি তোলায় অভিজ্ঞ হলেও আশিস হাতির ছবি তোলায় নবিশ ছিলেন। আর সেই অনভিজ্ঞতাই কি তাঁকে বিপদের দিকে ঠেলে দিল? এখন তো সকলের হাতে মোবাইল-ক্যামেরা। ডিএসএলআরধারীও কম নন। বহু শখের ফটোগ্রাফার। ইন্টারনেটে চমকপ্রদ ফটোগ্রাফির ছড়াছড়ি। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় ভাইরাল-ছবি। এত সব কারণে কি বেপরোয়া হওয়ার ঝোঁক বাড়ছে? না হলে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে নিজস্বী তুলতে গিয়ে কেন পলিটেকনিকের ছাত্র মারা যাবেন? শখের ফটোগ্রাফি মানেই কি ফেসবুকে লাইক আর ‘ওয়াও’ ইমোজি পাওয়ার ইচ্ছে? পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি থানার নছিপুরে বাড়ি সুশোভন পতির। সরকারি চুক্তিভিত্তিক কর্মী। মোবাইলে ছবি তোলেন। জানালেন, তাঁর শখ ছবি তোলায়। কিন্তু ঝুঁকি কখনও নেন না। তবে সুশোভন বললেন, ‘‘পরিচিত অনেককেই দেখেছি মোবাইলে বাইকে স্টান্ট করে ছবি তোলেন। ট্রেনে ঝুঁকেও তোলেন। এগুলো সবই ফেসবুকে প্রশংসা পাওয়ার জন্য।’’

যদিও অবসরপ্রাপ্ত বনাধিকারিক সমীর মজুমদার স্পষ্ট জানালেন, মোবাইলে ছবি তোলা আর বন্যপ্রাণীর ছবি তোলা অন্যগ্রহের বিষয়। সেখানে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলতে তো হবেই। সেই সঙ্গে যে প্রাণীর ছবি তোলার চেষ্টা করছেন তার গতিপ্রকৃতি, স্বভাবের সঙ্গে পরিচয় থাকতে হবে। তিনি জানালেন, সাধারণত হাতি হামলা করে না। কিন্তু বারবার তাকে বিরক্ত করা হলে নাগালের মধ্যে মানুষ পেলে মারবেই। হাতির কাছে ২০-৪০ ফুট দূরত্ব কিছুই নয়। হাতির শুঁড়ই ১০ ফুট। হাতি সোজা ছোটে। এঁকেবেঁকে ছুটলে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু জঙ্গলে এঁকেবেঁকে ছোটার কোনও সুযোগ ফটোগ্রাফারেরা পান না। তাছাড়া, হাতির শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি প্রবল। ঘুমন্ত হাতিও অল্প নড়াচাড়া বা মানুষের গন্ধ পায়। সমীরের কথায়, ‘‘অপেশাদার ফটোগ্রাফারদের একটা অভ্যাস হল, খুব কাছ থেকে ছবি তোলার শখ। খুব কাছ থেকে, শুঁড়, চোখ, দাঁতের ছবি তুলতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনেন তাঁরা। ছবি তুলতে তুলতে কখন হাতির কাছে চলে যান খেয়াল করতে পারেন না। হাতি তাড়া করে এক লহমায় মানুষকে নাগালে পেয়ে যায়।’’ তিনি জানাচ্ছেন, বন্যপ্রাণীর ছবি তুলতে গেলে পোশাক নিয়েও সচেতন থাকতে হয়। সাদা পোশাক হাতি খুব সহজেই দেখতে পায়। ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুললে আরও রেগে যায়।

ক্যামেরার ফ্ল্যাশে নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন, এরকম ঘটনা কয়েক মাস আগেই ঘটেছে। সাইকেলে ঝাড়খণ্ড থেকে ফেরা তিনজন ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়িতে হাতি দেখতে পান। একজন মোবাইল বের করে ছবি তোলেন। ফ্ল্যাশ জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে হাতি তেড়ে এসে পিষে দেয় তাঁকে। বেঁচে যাওয়া সঙ্গীরা জানিয়েছিলেন, হাতিটি অন্তত ৪০ ফুট দূরে ছিল। তা-ও ধরে ফেলে।

ঝাড়গ্রামের শিক্ষক তথা ফটোগ্রাফার বিশ্বরূপ মণ্ডল ছবি তুলতে ভালবাসেন। হাতির ছবি তুলেছেন। নেকড়ের ছবিও তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘নেকড়ের ছবি আচমকাই পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা হাতির ছবি তুলতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। কখনই কাছে যাই না। জঙ্গলেও যাই না। হাতির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল। হাতি জঙ্গলে বেরলো না। আমরা ফিরে চলে এলাম। হাতির গতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেই লোকে কাছাকাছি যান। অত বড় শরীর নিয়ে হাতি যা দৌড়য় না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’’ পাখির ছবি তোলেন শিবশঙ্কর গোস্বামী। তিনি জানালেন, ছবি তোলার ক্ষেত্রে দু’টি বিষয়কে গুরুত্ব দেন। কাউকে বিরক্ত না করা। আর কারও ক্ষতি না করা। বনের পশুপাখিদেরও নিজস্ব সময়, নিজস্ব মর্জি আছে। সেই অনুযায়ী চলা তাদের অধিকার। অপেশাদার মনোভাব নিয়ে যাঁরা ছবি তুলতে যান তাঁদের প্রতি বিরক্তিই প্রকাশ করলেন শিবশঙ্কর। জানালেন, এখন বিভিন্ন পাখির ডাক ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ডাক খিদে পাওয়ার, নাকি বিপদের না সঙ্গীকে আহ্বান তা না জেনেই জঙ্গলে গিয়ে বাজাতে শুরু করেন অপেশাদারেরা। প্রজনন ঋতু নয়, এমন সময় যদি সঙ্গীকে আহ্বানের ডাক বাজানো হয় তাতে পাখির শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি হয়। ডাকে সারা দিতে গিয়ে শত্রুর কবলেও পড়তে পারে সে।

অধ্যাপক এবং ‘মেদিনীপুরের পাখি’ বইয়ের লেখক সুমন প্রতিহার কোনও রাখঢাক না করেই জানালেন, ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি’ এখন বন্যপ্রাণীদের জন্য বিপদ। অপেশাদার ফটোগ্রাফারেরা কোনও ‘এথিক্সে’র ধার ধারেন না। বাসার ছবি তোলেন, অনেকে সময়ে ডিমের ছবি তোলেন। কেউ ডিমে হাত দিয়ে ছবি তুলতে চান। এতে মা-পাখি যদি একবার ভয় পেয়ে যায় তাহলে বাসায় আর ফিরতে না-ও পারে। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘অ্যামেচার ফটোগ্রাফারদের স্বভাব রয়েছে পাখিদের বিরক্ত করা। ওড়ার ছবি, ডানার ছবি তোলার প্রয়োজন হয়। কেউ ঢিল ছোড়ে। কেউ চিৎকার করে। পাখিদের শান্তিতে থাকতে দেয় না।’’

মুশকিল হল, ‘এথিক্স’ না মানাদের বোঝানো যায় না। বোঝাতে গেলে তাঁরা বলেন, ‘কিছু হবে না’। বেশি কড়াকড়ি করলে লুকোচুরি চলে। তাতে এঁরা বন্যপ্রাণের ক্ষতি করেন। নিজেদের বিপদও ডেকে আনেন। অথচ নিয়ম মেনে ছবি তুললেও ‘ভাইরাল’ হওয়া যায়। ইন্টারনেটে একটা ছবি পাওয়া যায়। এক ফটোগ্রাফার ছবি তুলছেন। আর তাঁর গায়ে চড়ে খেলছে কতগুলো মিরক্যাট। অকুতোভয়ে।

বন্যপ্রাণীদেরও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয়। যাতে তারা ছবি তুলিয়েকে বিপদ বলে মনে না করে।

অন্য বিষয়গুলি:

Selfie Danger Accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy