গোয়ালতোড়ের ভালুকবাসা গ্রামে ঢোকার মুখে পঞ্চায়েতের ফলক। নিজস্ব চিত্র rupsankar.2011@gmail.com
একসময় নকশালপন্থীদের সূতিকাগার ছিল গোয়ালতোড়ের ভালুকবাসার জঙ্গল। সেই জঙ্গল ও তার লাগোয়া ভালুকবাসা এখন পঞ্চায়েতের দৌলতে 'নির্মল' গ্রাম। গ্রামে ঢালাই রাস্তা, স্বচ্ছ পানীয় জল, আলোর ব্যবস্থা। গ্রামবাসীরা মাঠেঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করতে যান না। 'নিরাপদ' ভালুকবাসা জঙ্গলে বেমালুম ঢুকে জ্বালানির জন্য পাতা - শুকনো কাঠ নিয়ে আনেন গ্রামের বাসিন্দারা। ভালুকবাসা এখন ঘাসফুলের ছত্রছায়ায়।
গড়বেতা ২ (গোয়ালতোড়) ব্লকের মাকলি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ভালুকবাসা গ্রাম। গ্রাম লাগোয়া জঙ্গল, গ্রামের নামেই জঙ্গলের নাম। ভালুকবাসা জঙ্গলের একদিকে বাঁকুড়া জেলা, অন্যদিকে ঝাড়গ্রাম। গভীর সেই জঙ্গল ধরে সহজেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এমনকি বেলপাহাড়ির দিকেও যাওয়া যায়। এলাকাটি প্রত্যন্ত। তারই সুবিধা নিয়ে একসময় ভালুকবাসার জঙ্গল হয়ে উঠেছিল নকশালপন্থীদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। প্রথমে জনযুদ্ধ ও পরে মাওবাদীদের সূতিকাগার। বাম আমলে আট ও নয়ের দশকে এই জঙ্গলকে করিডর করেই পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ জারি রাখত পিপলস ওয়ার গ্রুপ বা জনযুদ্ধ গোষ্ঠী। ২০০৪ সালে নকশালপন্থী সংগঠনগুলি মিলিত হয়ে সিপিআই (মাওবাদী) গড়ে তুললেও, অপরিবর্তিত থেকে যায় ভালুকবাসা জঙ্গলের ঘাঁটি। জানা যায়, এই জঙ্গলে বসেই জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর কাজের নীল-নকশা তৈরি করতেন গড়বেতার সুদীপ চোংদার ওরফে কাঞ্চন, অসিত সরকার, চন্দ্রকোনার অসীম মণ্ডলরা। সুদীপ পরে মাওবাদীদের রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন। সুদীপ, অসিতরা মৃত হলেও, অসীম ওরফে আকাশ এখনও পুলিশের খাতায় ফেরার। এই ভালুকবাসা জঙ্গলেই বসত সাংগঠনিক বৈঠক, হত অস্ত্র প্রশিক্ষণ। বাম আমলের শেষের দিকে জনসাধারণের কমিটির নেতারা এসেও গোপনে সভা করতেন এখানে। কিসানজির উপস্থিতিতেও এখানে গোপন সভা হয়েছিল বলে জানা যায়। সেইসময় অনেকবারই এই জঙ্গলে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ, পরে যৌথ বাহিনী। হয়েছে গুলির লড়াই।
সেই ভালুকবাসা এখন শান্ত, নির্মল। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর ভালুকবাসাও বদলে গিয়েছে। জঙ্গলের দখল নিয়েছে বন দফতর। ভয় কেটেছে ভালুকবাসা গ্রামের। পঞ্চায়েতের দৌলতে ভালুকবাসা এখন 'নির্মল' গ্রাম। বেশ কয়েকবছর আগে মাকলি গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে ভালুকবাসাকে নির্মল গ্রামের তকমা দেওয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে গ্রামের উন্নয়ন হচ্ছে। হয়েছে ঢালাই রাস্তা, স্বচ্ছ পানীয় জলের ব্যবস্থা, প্রতি ঘরে বিদ্যুতের আলো, গ্রামে বাউন্ডারি দেওয়াল দেওয়া প্রাথমিক স্কুলে পড়তে যায় ছেলেমেয়েরা। গ্রামের পাশ কালো পিচের রাস্তা ভেদ করেছে ভালুকবাসার জঙ্গল। সেই রাস্তায় অহরহ গাড়ি যাতায়াত করছে বাঁকুড়া জেলার দিকে। জঙ্গলে জ্বালানি সংগ্রহে কাঠ- পাতা আনতে যান অনেকে। গ্রামবাসীরা বলছেন, "আগের সে সব দিন যেন না ফেরে, আমরা শান্তিতে আছি, উন্নয়নও হচ্ছে।" গ্রামের তৃণমূল নেতা বাবলু শীট বললেন, "ভালুকবাসায় জল, আলো, রাস্তা, প্রতি ঘরে শৌচাগার হয়েছে। কয়েকমাস আগে ঝড়ে আইসিডিএস কেন্দ্রটা পড়ে গিয়েছিল, সেটা এখন নতুন করে করতে হবে। এখানকার মানুষ শান্তিতেই আছেন।" মাকলি অঞ্চলের বিজেপি নেতা তথা দলের ঝাড়গ্রাম সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি অনিরুদ্ধ দে বলছেন, "নির্মল গ্রাম হয়েছে বটে, তবে এখনও ভালুকবাসায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি হয়নি অনেক গরিব মানুষের, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের শৌচাগার হয়েছে ২০ শতাংশের মতো।" মাকলি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান অঞ্জলি হেমব্রমকে ফোনে পাওয়া যায়নি। গড়বেতা ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীনবন্ধু দে বলেন, "ভালুকবাসা গ্রাম নির্মল হয়েছে, এখানে রাস্তা, জল, বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য উন্নয়ন হয়েছে, আরও হবে। আইসিডিএস কেন্দ্রের বিষয়টি দেখছি।"
২০১৮ সালের নভেম্বরে মাকলি অঞ্চলের ভালুকবাসা জঙ্গলের পাশের একটি মাঠ থেকে পুলিশের জালে ধরা পড়েছিলেন মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সব্যসাচী গোস্বামী ওরফে কিশোরদা। তাঁর সঙ্গে আরও ৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাঁদের কাছ থেকে মাওবাদীদের লিফলেটও পাওয়া গিয়েছিল বলে সেইসময় পুলিশ জানিয়েছিল। 'নির্মল' ভালুকবাসা জানে সেই খবর, তাই সতর্কও তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy