গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
‘বেগড়বাই’ করলেই রাষ্ট্রদোহের মামলা খেতে হবে। জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে এক সময় এ যেন ছিল প্রবাদ-বাক্য। গত এক দশকে সেই জঙ্গমহল বদলে গিয়েছে অনেকটাই। রাজনীতির স্রোতও নানা খাতে বয়েছে। তবে ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লায় যার ওজন বেশি, তুলনায় ‘দুর্বল’কে তার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার পুরনো ট্র্যাডিশন সমানে চলছে বলেই অভিমত রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে জনগণের কমিটির প্রাক্তন নেতা ছত্রধর মাহাতোর বিরুদ্ধে পুরনো রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার পুনর্তদন্ত শুরু করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনআইএ। এই আবহেই মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার পুরনো পন্থা ঘিরে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। ছত্রধর ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে অভিসন্ধি নিয়ে দু’টি মামলার পুনতর্দন্ত হচ্ছে। এর একটি মামলায় আবার ছত্রধর অভিযুক্তই নন। জেলমুক্ত হয়ে এলাকায় ফিরে ছত্রধর সরাসরি তৃণমূলে যোগ না দিলেও তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছেন। দলীয় কর্মসূচিতেও যাচ্ছেন। ফলে, ছত্রধরের অনুগামীদের আশঙ্কা, তাঁর কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই ‘মামলা-অস্ত্র’ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ছত্রধর নিজেও বলছেন, ‘‘দশ বছরেরও বেশি জেলে কাটিয়ে এলাকায় ফিরেছি। মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি। রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিতেই হয়রানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’’
২০০৯ সালের ১৪ জুন লালগড়ের ধরমপুরে খুন হন সিপিএম কর্মী প্রবীর মাহাতো। প্রবীরের ভাইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে ছত্রধর-সহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে খুন ও রাষ্ট্রদ্রোহের ধারায় ২০১০ সালে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। ছত্রধর বাদে বাকি অভিযুক্তরা জামিন পান। পরে তিন অভিযুক্তের মৃত্যু হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ছত্রধর জেলমুক্ত হয়ে এলাকায় ফিরতেই এই মামলার পুনর্তন্তের জন্য কলকাতার বিশেষ আদালতে আবেদন জানায় এনআইএ। সেই সঙ্গে ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর ঝাড়গ্রামের বাঁশতলা স্টেশনে ছত্রধরের মুক্তির দাবিতে রাজধানী এক্সপ্রেস আটকের মামলাটিরও পুনর্তদন্ত করতে চেয়ে আদালতে যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। দু’টি আবেদনই মঞ্জুর হয়। এনআইএ সূত্রে খবর, কলকাতার এনআইএ বিশেষ আদালত থেকে ঝাড়গ্রাম আদালতের কাছে ওই দু’টি মামলার নথি চাওয়া হয়েছে। তবে সূত্রের খবর, করোনা পরিস্থিতিতে এখনও নথি পৌঁছয়নি।
ছত্রধর ও অন্য অভিযুক্তদের আইনজীবী কৌশিক সিংহের প্রশ্ন, ‘‘দু’টি মামলাই দায়রা সোপর্দ হয়ে বিচার শুরুর অপেক্ষায়। বছর দশেক আগে দু’টি মামলার চার্জশিট জমা পড়লেও এতগুলো বছরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা পুনর্তদন্তের প্রয়োজনবোধ করল না।’’ কৌশিক আরও মনে করিয়ে দেন, রাজধানী এক্সপ্রেস আটকের মামলায় ছত্রধর অভিযুক্তই নন। ওই সময়ে তিনি জেলবন্দি ছিলেন।
ছত্রধর জেলমুক্ত হওয়ার পরে দু’টি মামলার পুনর্তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকার কর্মীরাও। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এই প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বার বার অশান্ত হয়েছে জঙ্গলমহল। মানবাধিকার কর্মী অঙ্কুর মণ্ডলের মতে, ‘‘জঙ্গলমহলের আদিবাসী-মূলবাসীদের সমস্যা নিয়ে যাঁরাই সরব হয়েছেন, তাঁদেরই নানা ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। সরকারের রং ও মুখ বদলালেও তাদের কাজের কোনও প্রভেদ নেই। এত বছর পরে মামলার পুনর্তদন্ত সেটাই প্রমাণ করছে।’’
অধ্যাপক ও মানবাধিকার কর্মী ফটিকচাঁদ ঘোষও বলেন, ‘‘আগের বাম সরকার বহু প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও নাশকতার মামলা দায়ের করে অনেককেই বছরের পর বছর জেলবন্দি করে রেখেছিল। ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূলের জমানায় প্রতিহিংসার রাজনীতি চরিতার্থ করতে বেশ কয়েকজনকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জেলে ঢোকানো হয়েছিল। মনে হচ্ছে, ছত্রধরের ক্ষেত্রে এ বার সেই পথে হাঁটছে কেন্দ্রও।’’
ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভানেত্রী বিরবাহা সরেন বলছেন, ‘‘ছত্রধরের আইনি বিষয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। তবে বিজেপি তো সব ক্ষেত্রেই চক্রান্ত করছে।’’ এক সময়ে ছত্রধরের ছায়াসঙ্গী লালগড় ব্লক তৃণমূলের সভাপতি শ্যামল মাহাতোর অভিযোগ, ‘‘ছত্রদাকে আটকাতে এটা বিজেপি-র চক্রান্ত।’’ জেলা বিজেপি-র সভাপতি সুখময় শতপথী অবশ্য এতে বিতর্কের কিছু দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যের পুলিশের তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়ে এনআইএ যদি পুনর্তদন্ত করতে চায়, তাতে আপত্তি কোথায়!’’
ছত্রধরও বলছেন, ‘‘আমি ভীত নই। আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy