Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

ঘুরে দাঁড়িয়ে, লোকশিল্পে সচেতন করে পড়ুয়া-বন্ধু

বিদ্যালয়গুলো এখন বুনিয়াদি শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছে। শিক্ষকেরা শুধু পড়ান না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বাস্থ্যশিক্ষাও দেন। গড়ে তোলার চেষ্টা হয় পূর্ণাঙ্গ মানবরূপে। সফল স্কুল হয় শিশুমিত্র। পুরস্কার পাওয়া স্কুলগুলো কোন দিক দিয়ে আলাদা? খোঁজে আনন্দবাজারদেওয়ালি পুতুল, মহিষের শিংয়ের সামগ্রী যে তৈরি হয় খাস মেদিনীপুরে? বিদ্যালয় শেখায় সেসবও।

সামাজিক: পলাশি প্রাথমিকের দেওয়ালে।  নিজস্ব চিত্র

সামাজিক: পলাশি প্রাথমিকের দেওয়ালে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:১৩
Share: Save:

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয় খাবারদাবার নিয়ে একটি পাঠ। তা থেকে শিশুরা জানতে পারে আলু এসেছে ‘অনেক দূরের দেশ থেকে’। টম্যাটো বিদেশি। কিন্তু দেওয়ালি পুতুল, মহিষের শিংয়ের সামগ্রী যে তৈরি হয় খাস মেদিনীপুরে? বিদ্যালয় শেখায় সেসবও। স্কুলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সবুজায়ন, পড়ুয়াদের উপস্থিতির হার, মিড ডে মিলের গুণগতমান, পানীয় জলের ব্যবস্থা, শৌচাগারের পরিকাঠামো-সহ বিভিন্ন বিষয় দেখেও পুরস্কার দেওয়া হয়।

পশ্চিম মেদিনীপুরের তিনটি স্কুল ‘শিশুমিত্র’ পুরস্কার পেয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শালবনির ভাদুতলা হাইস্কুল। প্রাথমিক স্তরে মেদিনীপুর সদর ব্লকের পলাশি প্রাথমিক স্কুল এবং চন্দ্রকোনা ২ ব্লকের বালা প্রাথমিক স্কুল। ভাদুতলা হাইস্কুল ২০১৫ সালে ‘নির্মল বিদ্যালয়’ পুরস্কার পেয়েছে। স্কুলে কন্যাশ্রী এবং আইনি সচেতনতা ক্লাব রয়েছে। এলাকায় অনেক মেয়েরই কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা ইতিমধ্যে কয়েকজন নাবালিকার বিয়ে রুখেছে। তারা সচেতনতা গড়ে তোলারও চেষ্টা করছে।’’ কন্যাশ্রী ক্লাবের নাম ‘বহ্ণিশিখা’। ইকো ক্লাব ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইকো ক্লাব’। স্কুল ও স্কুলের আশেপাশের এলাকার পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, বাসিন্দাদের সচেতন করে দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ইকো ক্লাব গঠন করা হয়েছে। স্কুল চত্বরে বাগান রয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষামূলক ভ্রমণে যায়।

২০১২ সালে ‘নির্মল বিদ্যালয়’ পুরস্কার পাওয়া বালা প্রাথমিক স্কুলের বাগানে ফল, ফুল, আনাজ হয়। খেলার জন্য পরিপাটি মাঠ। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রঘুনাথ ধর বলেন, ‘‘শিশুমিত্র পুরস্কার বড় প্রাপ্তি।’’ পলাশি প্রাথমিক স্কুলে রয়েছে শিশু সমবায়। পড়ুয়াদের জন্মমাস পালন করা হয়। স্কুলের পত্রিকা ‘হাতেখড়ি’ বছরে দু’বার প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে ‘নির্মল বিদ্যালয়’ পুরস্কার পাওয়া পলাশি প্রাথমিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সৌম্যসুন্দর মহাপাত্রের কথায়, ‘‘স্কুলকে পরিচ্ছন্ন শিশুবান্ধব করারই স্বীকৃতি এই শিশুমিত্র পুরস্কার।’’ সমগ্র শিক্ষা মিশনের জেলা আধিকারিক সৌমনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জেলার তিনটি স্কুল এ বার শিশুমিত্র পুরস্কার পেয়েছে। আমরা সকলেই খুব খুশি।’’

পূর্ব মেদিনীপুরে পদুমবসান হারাধন প্রাথমিক বিদ্যালয়, দেভোগ পূর্ব প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাতিবেড়িয়া অরুণচন্দ্র হাইস্কুল ‘শিশুমিত্র’ পুরস্কার পেয়েছে। হারাধন প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’, ‘বেস্ট পারফর্মিং অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘সবুজ ক্ষুদিরাম পুরস্কার’ পেয়েছে। বর্তমান ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ১৬৯ জন। শিক্ষক সাতজন। ট্রেনের বগির আদলে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুলের দু’টি কক্ষ। নাম তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস। তমলুক রেল স্টেশনের আদলে স্কুলের বারান্দা। বিদ্যালয় জুড়ে নানান অলংকরণ। চারটি মিউজিয়াম রয়েছে স্কুলে। একটিতে বিভিন্ন মাছ, সাপ, নানা প্রাণী। রয়েছে ১০০ বছরের প্রাচীন অসংখ্য মুদ্রা, পুথি, দেওয়ালি পুতুল, মহিষের শিংয়ের কাজ, পোড়ামাটির সামগ্রী, মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের ইট, বাঁশের সামগ্রী, তালপাতার সেপাই, বাঁশি, খালই, পুরুলিয়ার মুখোশ, অসমের জাপি এবং একশোর বেশি ঝিনুক ও শঙ্খ! পটচিত্র সম্পর্কে ধারণা দিতে স্কুলের দেওয়ালে আঁকা মেদিনীপুর ও কালীঘাটের পটচিত্র। পিংলা থেকে দুখুশ্যাম চিত্রকরকে এনে পটের গানের আয়োজন হয়। প্রতি বছর আলপনা ওয়ার্কশপ করা হয় পড়ুয়া ও অভিভাবকদের নিয়ে। নিয়মিত গান, আবৃত্তি, গল্পবলা, বিপর্যয় মোকাবিলা, ছড়া বলা, নাচের কর্মশালা হয় স্কুলে। হয় রক্তদান শিবিরও। বিদ্যালয়ের মধ্যেই বিশাল শিশু উদ্যান।, কিচেন গার্ডেন, গ্রন্থাগার। বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে স্কুলের দেওয়ালে তাঁর জীবনের নানা তথ্য ছবি-সহ উল্লেখ করা। পড়ুয়াদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মুদ্রিত পত্রিকা ‘কচিপাতা’ এবং দেওয়াল পত্রিকা ‘কুঁড়ি’।

হলদিয়ার সুতাহাটা দক্ষিণ চক্রের অন্তর্গত দেভোগ পূর্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়ুয়ার সংখ্যা ১৭০। শিক্ষক ছ’জন। স্কুলের সামনে কিচেন গার্ডেন ও ভেষজ বাগান। প্রশিক্ষক এনে শেখানো হয় নাচ, গান, আবৃত্তি, অঙ্কন ও যোগাসন। রয়েছে স্মার্টক্লাস। প্রতি বছর ব্রতচারীর শিবির হয়। ইনডোর, আউটডোর গেম শেখানো ও প্রতিযোগিতা হয়। অনুষ্ঠিত হয় আন্তঃস্কুল ক্যুইজ প্রতিযোগিতা। শিশুদের পরামর্শ নিয়ে স্কুল পরিচালনা করেন শিক্ষক শিক্ষিকারা। স্কুলে আছে ‘জল ধরো জল ভরো প্রকল্প’। স্কুলের আনাজ দিয়েই মিড ডে মিলের অধিকাংশ দিন রান্না হয়। ২০১৭ সালে ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’, ’১৮ সালে মেলে ‘বেস্ট পারফর্মিং অ্যাওয়ার্ড’। প্রধান শিক্ষিকা ইন্দ্রাণী প্রধান মণ্ডল বলেন, ‘‘শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য যতটুকু পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায় তার চেষ্টা আমরা করেছি। অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের জন্য শিশুদের কোনও টাকা দিতে হয় না। স্কুল খরচ দেয়।’’

ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির স্কুল মাছকাঁদনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লড়াইটা অন্যরকম। পুলিশের চর সন্দেহে মাওবাদীরা স্কুলে শিশুদের সামনে পাথর দিয়ে থেঁতলে খুন করে প্রধান শিক্ষক করমচাঁদ সিংহকে। ২০০৮ সালে ওই ঘটনার পরে বন্ধ হয়ে স্কুলটি। প্রত্যন্ত সেই স্কুলই এবার পেল শিশুমিত্র পুরস্কার। চতুর্থশ্রেণির শিশু সংসদের ‘প্রধানমন্ত্রী’ সুজয় দাসের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। টিচার-ইনচার্জ স্নেহাশিস দাস স্নেহাশিস বলেন, ‘‘২০১০ সাল থেকেই স্কুলটি ঠিক মতো ফের চালু হয়। পড়ুয়া ছিল মাত্র ১৪ জন। এখন পড়ুয়া সংখ্যা ৯১ জন।’’ তাঁকে নিয়ে স্থায়ী শিক্ষক তিনজন, দু’জন পার্শ্বশিক্ষিকা। লাগাতার সচেতনতা শিবির করে, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভয় কাটানো হয়েছিল। বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী অনিমা সিং এ বছর লং জাম্পে জেলায় প্রথম হয়েছে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েছে। স্কুল ভবন আর শ্রেণিকক্ষের দেওয়াল আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। রয়েছে স্বাস্থ্যসচেতনতা, হাত ধোয়া ও শৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা ছবি ও সচেতনতামূলক লেখা। স্কুলের প্রাঙ্গণে রয়েছে মিড ডে মিল খাওয়ার দৃষ্টিনন্দন শেড। সাব মার্সিবল পাম্পের জলের মান প্রতি ছ’মাস অন্তর পরীক্ষা করানো হয়। শ্রেণিকক্ষের সমস্যা সত্ত্বেও এককোণে করা হয়েছে ‘রিডিং কর্নার’। স্কুলে দু’ধরনের আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন রয়েছে। পচনশীল আবর্জনা আনাজ খেতের সার হয়। শেখানো হয় মাটির পুতুল, শালপাতার সামগ্রী তৈরি।

স্কুলের গ্রন্থাগারের ঘর নেই। তবে আলমারি ভর্তি নানা বই। টিচার-ইনচার্জ স্নেহাশিস দাস বলেন, ‘‘যা রয়েছে তা দিয়েই আমরা স্কুলটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার চেষ্টা করছি। অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষের জন্য বিদ্যালয় পরিদর্শকের দফতরে আবেদন করা হয়েছে। মঞ্জুর হলে স্মার্টক্লাস চালু করার ইচ্ছে।’’

ঝাড়গ্রামের বিনপুর ১ চক্রের বসন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ও শিশুমিত্র। স্কুলে পড়ুয়া ৯৬ জন। স্থায়ী শিক্ষক চারজন, একজন পার্শ্বশিক্ষিকা। রয়েছে কিচেন গার্ডেন। পড়ুয়াদের নামে রোপণ করা হয়েছে মেহগনি, দেবদারু, গামার গাছ। গাছগুলিতে পড়ুয়াদের নেমপ্লেট দেওয়া আছে। টিচার ইনচার্জ রাজু ঘোষ জানান, এখন ৩৫টি গাছ পড়ুয়াদের নামে। বাকি পড়ুয়াদের নামে ফুল ও আনাজের গাছ। তবে শ্রেণিকক্ষের অভাব রয়েছে। পড়ুয়াদের হাত ধোয়ার জল যায় আনাজ বাগানে। হাত ধোয়ার প্রতিটি পর্যায় স্কুলের দেওয়ালে চিত্রিত। পরিত্যক্ত ঘর সারিয়ে শিশুসংসদের অফিস হয়েছে। সেখানে গ্রন্থাগার এবং পড়ুয়াদের হাতের কাজের সংগ্রহশালাও। শিশু সংসদের প্রধানমন্ত্রী চতুর্থ শ্রেণির ভবতোষ মাহাতো জানায়, শিশু সংসদের বৈঠকে নানা বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়। টিচার-ইনচার্জ রাজু ঘোষ জানালেন, শিশু নির্যাতন ও যৌন হেনস্থা রুখতে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় অডিও ভিজ্যুয়্যাল মাধ্যমে সচেতনার পাঠ দেওয়া হয়। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে দু’ধরনের ডাস্টবিন রয়েছে। সাংস্কৃতিক ও যোগ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ইন্ডোর গেমেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অভিভাবকরা চান, শ্রেণিকক্ষ বাড়িয়ে পঞ্চম শ্রেণি চালু হোক।

তথ্য সহায়তা: বরুণ দে, কিংশুক গুপ্ত, দিগন্ত মান্না

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy