ইয়াস বিধ্বস্ত মন্দারমণি উপকূল। ফাইল চিত্র।
উপকূলের বিধি ভেঙেই ইয়াস-ক্ষতির মেরামত। নজর নেই প্রশাসনের। খোঁজ নিল আনন্দবাজার
কোস্টাল রেগুলেশন জোন আইনকে (সিআরজেড) বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যের মন্দারমণিতে মাথা তুলেছে একের পর এক হোটেল। যাদের কারও কাছেই সিআরজেড-এর ছাড়পত্র নেই বলে অভিযোগ। অভিযোগের যে যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে ইয়াসে মন্দারমণিতে একাধিক হোটেলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে। যেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন একেবারে সমুদ্র সৈকতের গা ঘেঁষে হোটেল নির্মাণ নিয়ে। যা তাঁর প্রশাসনকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
কোস্টাল রেগুলেশন জোন আইন থেকেও কী ভাবে ছাড়পত্র পাচ্ছে এই সব নির্মাণ। স্থানীয় রামনগর-২ ব্লকের কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান স্বপন দাস অবশ্য হাত ধুয়ে ফেলেছেন। সরাসরি পূর্বতন সরকারে ঘাড়ে দায় চাপিয়ে তাঁর দাবি, ‘‘ওই এলাকাগুলিতে নির্মাণ কাজের জন্য ২০০৮ সালের আগে অনুমোদন দিয়েছে পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। তারপর নতুন করে আর কিছু গড়ে ওঠেনি। কাউকে কোনও অনুমতিও দেওয়া হয়নি।’’ তবে মন্দারমণির বাস্তব ছবি অন্য কথা বলছে। ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর ৫০টিরও বেশি হোটেল গড়ে উঠেছে এখানে। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী এই নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরেও ইয়াস পরবর্তীতে সমুদ্রসৈকত লাগোয়া ক্ষতিগ্রস্ত হোটেলগুলিতে ফের মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে। বন্ধ নেই নতুন হোটেল নির্মাণও। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনিক নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন
তুলেছে বিরোধীরা।
১৯৯১ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার সিআরজেড সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ২০০৮ সালে এই সংক্রান্ত ফের একটি খসড়া প্রকাশ করে কেন্দ্র। তাতে উপকূল এলাকায় বসবাসকারী বিশেষত মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের লোকদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি সেভাবে উল্লেখ না থাকায় তারা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের চাপে তাদের দাবি মেনে নেয় তৎকালীন ইউপিএ সরকার। ২০১৯ সালে কেন্দ্র ফের বিজ্ঞপ্তি জারি করে এবং সেখানে সিআরজেড সংক্রান্ত কিছু সরলীকরণ ঘটানো হয়। বলা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার মধ্যে ৩০০ বর্গমিটারে নির্মাণকাজের অনুমোদন স্থানীয় প্রশাসন দিতে পারবে। বলাবাহুল্য তার পরেও দাদনপাত্রবাড়, সিলামপুর, সোনামুই এবং দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর মৌজায় ঘর তৈরির জন্য সরকারি আবাস যোজনা প্রকল্পে আর্থিক অনুদান দেওয়া বন্ধ রয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। বছর কয়েক আগে দাদনপাত্রবাড়ে সরকারি উদ্যোগে বসানো হয়েছিল একটি গভীর নলকূপ। কিন্তু পরিবেশপ্রেমী একটি সংগঠনের মামলার প্রেক্ষিতে ওই নলকূপও সেখান থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্যের পরিবেশ আদালত। অথচ এরপরেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটার পর একটা হোটেল এবং লজ গড়ে উঠছে!
স্থানীয় এক হোটেল মালিকের কথায়, ‘‘পাট্টার জমিতে বাড়ি তৈরির জন্য পঞ্চায়েতের কাছ থেকে বিল্ডিং-এর প্ল্যান পাশ করানো এবং দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হচ্ছে। সমস্ত কিছুই করা হচ্ছে কয়েক বছর আগের তারিখে। এর জন্য চলে বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন।’’ রামনগর-২ এর বিডিও বিপ্রতীক বসাক বলেন, ‘‘কোস্টাল রেগুলেশন জোন আইন মানা হচ্ছে কি না তা নিয়ে নিয়মিত নজরদারি চলে। নতুন করে কোনও হোটেল নির্মাণের অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই পদক্ষেপ করা হবে।’’
দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক মানস কুমার মণ্ডল অবশ্য বলেন, ‘‘মন্দারমণিতে অনেক আগে থেকেই সব রকমের নির্মাণ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। রাজ্য সরকার নতুন নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত যাতে কোনও নির্মাণ না হয় সে জন্য মাঝেমধ্যে অভিযান চলে।’’ যা নিয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দার কটাক্ষ, ‘‘অভিযান তো নামেই। আসলে টাকার লেনদেন নিয়েই আলোচনা চলে।’’
প্রসঙ্গত, সিআরজেড আইন সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে জেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কমিটির মাথায় রয়েছেন জেলাশাসক। কমিটিতে উপকূল এলাকায় মৎস্যজীবী সংগঠনগুলির তিন জন প্রতিনিধি রাখার কথা বলা হলেও তা মানা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী ইউনিয়নের সভাপতি তমালতরু দাস মহাপাত্র। এ ব্যাপারে জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাঝি বলেন, ‘‘সিআরজেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ওই এলাকায় যাতে কোনওরকম নির্মাণ না হয় সে জন্য আমরা কঠোর পদক্ষেপ করছি।’’
গোটা বিষয়টিকে কটাক্ষ করে বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি অনুপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় এসে গরিব মানুষের সবকিছু ছারখার করে দিয়ে গেলে তখন উপকূল রক্ষা আইন নিয়ে প্রশাসন খুব তৎপরতা দেখায়। কিছুদিন পরে ফের যে কে সেই। রাজনাতি আর টাকার খেলায় ধ্বংস হতে বসেছে উপকূলের বাস্তুতন্ত্র।’’ (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy