বেহাল: এমন মাঠেই অনুশীলন। নিজস্ব চিত্র
মিলখা সিংহ উড়ন্ত শিখ। কিন্তু ছোটবেলাতেই তাঁর ‘ডানা’ মুচড়ে গিয়েছিল জীবনযুদ্ধে। দেশভাগের হিংসায় হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। খেলাধুলো তো দূরের কথা। অর্থের অভাবে বিনা টিকিটে রেলে চড়ে গ্রেফতার হয়ে জেলে গিয়েছিলেন। এই কিংদবন্তীকে দেশ পেতই না যদি না তিনি সেনাবাহিনী যোগ দিতেন।
যুবরাজ সিংহের পছন্দের খেলা ছিল টেনিস এবং রোলার স্কেটিং। অনূর্ধ্ব ১৪ রোলার স্কেটিংয়ের জাতীয় প্রতিযোগিতাতেও পদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা যোগরাজ সেই পদক ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যুবরাজকে সুযোগ পেতে হবে জাতীয় ক্রিকেট দলে। প্রাক্তন ক্রিকেটার বাবার ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন যুবরাজ।
২৫ ও ২৬ জানুয়ারি বেঙ্গল অলিম্পিক্স অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে সপ্তম নেতাজি সুভাষ স্টেট গেমস হয় কলকাতার সাই কমপ্লেক্সে। বিভিন্ন জেলার কৃতীরা এই প্রতিযোগিতায় ডাক পেয়েছিল। অ্যাথলেটিক্স বিভাগে পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র একজন ডাক পেয়েছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির দামাকাটা গ্রামের অজয় মাহাতো। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে তিনটি জেলা থেকে মাত্র একজন অ্যাথলিট কেন? সেই উত্তর খুঁজতেই মিলল পরিকাঠামোর অভাব এবং সঠিক দিশা দেখানোর প্রশিক্ষকের খামতির কথা। অবশ্য এক ক্রীড়াকর্তা জানান, সারা বছর যারা রাজ্য ও জাতীয় স্তরে ভাল ফল করে বেঙ্গল অলিম্পিক্স অ্যাসোসিয়েশন তাদেরই সুযোগ দেয়। জেলা বা রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতায় কোনও ইভেন্টে প্রথম বা দ্বিতীয় হলেই যে ডাক পাবে, তা নয়। বেঙ্গল অলিম্পিক্স অ্যাসোসিয়েশন একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠি স্থির করে। সেই অনুযায়ী ডাকা হয় ছেলে মেয়েদের।
অজয় পিড়াকাটা হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। রাজ্য ও জাতীয় প্রতিযোগিতায় ভাল ফল করেছে। অজয়ের প্রশিক্ষক আদিনাথ ভট্টচার্য বলেন, ‘‘নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করলে ও অনেক ভাল জায়গায় পৌঁছবে। কিন্তু আমাদের জেলায় মাঠের অভাব রয়েছে। খড়্গপুরে অস্থায়ী ভাবে একটি ৪০০ মিটার ট্র্যাক তৈরি করেছি। অজয় এখন খড়্গপুরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।’’ একই কথা ক্রীড়া পরিচালকদেরও। সেখানে আবার দোষারোপের পালা। মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাথলেটিক্স শাখার সম্পাদক ইতি বর্মনের দাবি, ‘‘জেলার অ্যাথলেটিক্স বিভাগের পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। এর আগে যারা এই শাখার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা কোনও কাজ করেননি। তাই এখন জেলায় অ্যাথলিটের সংখ্যাও কমেছে।’’ তিনি জানিয়েছেন, জেলায় মাঠের অভাব রয়েছে। একটি মাত্র মাঠ অরবিন্দ স্টেডিয়ামেই ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স এক সঙ্গে করা যায় না। এখন দিন ভাগ করে অনুশীলন হয়। ৪০০ মিটার দৌড়নোর কোনও ট্র্যাক নেই। ২০০ মিটার ট্র্যাকেই ৪০০ মিটার, ৮০০, ১৫০০ মিটার হয়। জেলায় বিভিন্ন মাঠের অবস্থা বেহাল। ইতি নিজে মহকুমাশাসক তথা জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রশাসকের কাছে এ বিষয়ে জানিয়েছেন। ইতিদেবী বলেন, ‘‘পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। মহকুমাশাসক আশ্বাস দিয়েছেন। পরিকাঠামোর বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার জন্য টেন্ডার হয়েছে।’’
জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাথলেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান স্বদেশরঞ্জন পান জানান, ভাল অ্যাথলিট খোঁজার উদ্যোগের অভাব রয়েছে। প্রতিভা খুঁজতে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন খেলায় নির্বাচকদের পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। জেলায় অভিভাবকদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে বলেও মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘ছেলে মেয়েদের কোন খেলায় দেবেন, কখন দেবেন, কোথায় দেবেন এ নিয়ে তাঁদের স্পষ্ট কোনও চিন্তা ভাবনা নেই। সমস্যার সমাধানে বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। ক্রীড়া শিক্ষক সঠিক ভাবে ছেলে মেয়েদের মাঠে নিয়ে গিয়ে খেলাধুলো করালে টালেন্ট সার্চের কাজ এগিয়ে থাকে।’’ তিনি জানিয়েছেন, জেলায় অ্যাথলেটিক্সে যারা যোগ দেয় তাদের বেশির ভাগই স্বচ্ছল পরিবারের নয়। তাই তাদের ভাল জুতো ও পোশাক থাকে না। এছাড়া অ্যাথলেটিক্সে খুবই পরিশ্রম করতে হয়। সেই তুলনায় পুষ্টিকর খাবার পায় না।
কী ভাবে সাফল্য আসবে? স্বদেশরঞ্জন বলেন, ‘‘ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। বিভিন্ন ইভেন্টের
পরিকাঠামোর উন্নতির পাশাপাশি সারা বছর ধরে ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য অর্থ লাগে। কী ভাবে সংস্থার আয় বাড়ানো যায় সে বিষয়ে কর্তাদের ভাবনা চিন্তা করতে হবে।’’ তিনি জানিয়েছেন, ‘‘জেলার ক্রীড়া প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষক কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। কেবলমাত্র কয়েকটি ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উপর ভরসা করে জেলার দল তৈরি করা হয়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যাতে প্রশিক্ষক দিয়ে ক্রীড়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করা যায় সে দিকে নজর দিতে হবে।’’ মেদিনীপুর শহরের এক প্রশিক্ষক সুব্রত পান বলেন, ‘‘জেলায় পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। ছেলে মেয়েরা সাধারণ জুতো পরে মাটিতে অনুশীলন করে। কারণ স্পোর্টসের রানিং শ্যু পরে মাটিতে অনুশীলন করা যায় না। এরাই যখন রাজ্য ও জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতায় সিন্থেটিক ট্র্যাকে রানিং শ্যু পরে প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় তখন মানিয়ে নিতে অনেক অসুবিধে হয়। ফলে ভাল ফল হয় না।’’ সুব্রতবাবুর প্রস্তাব, জেলা প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিভাবানদের বাছাই করে সিন্থেটিক ট্র্যাকে অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে সপ্তাহে দু’দিন কলকাতার যুব আবাসে রেখে অনুশীলনের ব্যবস্থা করা বা রাজ্যে প্রতিযোগিতার আগে ১০-১৫ দিন আগে বাছাই ছেলে মেয়েদের কলকাতায় সিন্থেটিক ট্র্যাকে অনুশীলনের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়।
পূর্ব মেদিনীপুরে শুধুমাত্র হলদিয়া মহকুমার মহিষাদল ও তমলুক মহকুমার কোলাঘাটে সারা বছর অ্যাথলেটিক্সের চর্চা হয়। অন্য প্রান্তে প্রতিযোগিতার সময় বাছাই করা হয়। জেলার এক ক্রীড়াকর্তা জানান, এখন সকলে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবলের মতো টিম গেম নিয়েই আগ্রহী। সেসব খেলার আয়োজন করার জন্য স্পনসর পাওয়া যায়। অ্যাথলেটিক্স ব্যক্তিগত খেলা। দর্শক আসে না। স্পনসরশিপ পাওয়া যায় না। তাই অভিভাবকদের আগ্রহ কম। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সম্পাদক বিপ্লব চক্রবর্তী জানান, জেলায় অ্যাথলেটিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের অভাব রয়েছে। সে জন্যই জেলার সেরা রাজ্য স্তরে গিয়ে ভাল ফল করতে পারে না। বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘যত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতা হয় তাঁর স্ট্যান্ডার্ড তত বেশি হয়। যেমন রাজ্যস্তরে ১০০ মিটার দৌড়ের মাপকাঠি যদি ১৪ সেকেন্ড হয় জাতীয় স্তরে ১২ সেকেন্ড হয়ে যায়। এর জন্য সারা বছর সঠিক পদ্ধতিতে কঠোর অনুশীলন প্রয়োজন।’’ ছেলেদের মান বাড়ানোর উপায় কী? এক ক্রীড়াকর্তা জানান, বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য জেলার বিভিন্ন ব্লকে একটি করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করতে হবে। বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘আমি বিভিন্ন ব্লক ও মহকুমার ক্রীড়াকর্তা ও ক্লাবকর্তাদের বলেছি। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করলে প্রশিক্ষক পাঠাব। কাঁথি ও এগরা মহকুমায় একটি করে প্রশিক্ষণ শিবির হওয়ার কথা চলছে।’’
ঝাড়গ্রাম জেলায় অ্যাথলেটিক্সের কোনও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। মেদিনীপুরে গিয়ে ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। নিয়মিত মেদিনীপুর যাতায়াত করার মতো সময় ও আর্থিক সামর্থ্য সকলের নেই। ঝাড়গ্রাম মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক অমিত হাজরা জানান, আগে অনেক শিক্ষক সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতেন। এখন শিক্ষকেরা মাঠে যান না। অমিতবাবু বলেন, ‘‘নতুন জেলায় খেলার পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য রাজ্য থেকে ৪ লক্ষ টাকা এসেছিল। কিন্তু সেই টাকা ফেরত গিয়েছে। এভাবে জেলার খেলার উন্নতি হয় না।’’
দোষারোপ, পরিকাঠামো এবং পথ প্রদর্শকের অভাব, ত্র্যহস্পর্শ বাঁচিয়ে অজয় লড়ছে একা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy