গত বছর কনকাবতী এলাকায় কংসাবতীর তীরে আসা চখা-চখির দল। ছবি সুমন প্রতিহারের সৌজন্যে
আমলকি বনে খবর ছড়িয়ে পড়ে আপনাআপনি। তারা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করে, এবার পাতা খসানোর সময় হয়েছে। প্রকৃতির নিয়মই এরকম। খবর ভেসে যায় আপনাআপনি। যে খবর পেয়ে ডানা মেলতে শুরু করে পরিযায়ী পাখিরা। শীতের শুরুতে এসে যায় চেনা জলাশয়ে। বা নতুন জঙ্গলে। প্রতি বছরই তারা দূরদূরান্ত থেকে আমাদের এলাকায় অতিথি হয়ে আসে। এ বছরেও আসতে শুরু করেছে। কিন্তু আমরা কি তাদের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত থাকি? গত বছর অতিথিরা যে সমস্যায় পড়েছিল, এ বছর কি সেই সমস্যা মিটিয়ে তাদের অস্থায়ী আস্থানা তৈরি রাখতে পেরেছি? খবর নিয়ে দেখা যাক।
পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু এলাকায় কমবেশি পরিযায়ী পাখি আসে। এ বছরেও আসতে শুরু করেছে। শালবনির গোদাপিয়াশাল, ভাদুতলা, কেশিয়াড়ির খাজরা, মেদিনীপুরের কংসাবতীর আশেপাশে পরিযায়ী পাখির দল আসে। মূলত ওই সব এলাকার বিভিন্ন ঝিলে, জলাশয়ে পরিযায়ীদের দেখা যায়। অবশ্য গত কয়েক বছরে পরিযায়ীদের সংখ্যা কমেছে। বিশেষ করে কংসাবতীর আশেপাশের এলাকায় এই কারণে পরিযায়ীদের সংখ্যা কমেছে। কেন? দফতরের এক সূত্রের মতে, এর প্রধান কারণ হল, জলাশয়ের দূষণ। দুই, মাইকের তাণ্ডব। তিন, মাছ ধরার প্রবণতা। চার, চোরাশিকারিদের উপদ্রব। পাঁচ, খাদ্যের অভাব। জেলার এক বন আধিকারিকের স্বীকারোক্তি, ‘‘এই সময়ের মধ্যে কিছু জলাশয় দূষিত হয়েছে। জলাশয়গুলি কচুরিপানায় ভরে থাকে। পরিষ্কার করা হয় না। কিছু ক্ষেত্রে জলাশয়ে দূষণের জেরে সেই ভাবে আর পরিযায়ীরা আর আসে না।’’ পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে একটি শ্রেণি জলাশয় নির্ভর। ফলে জলাশয় অপরিষ্কার থাকলে তাদের পক্ষে সেখানে থাকা মুশকিল। পাশাপাশি, একাধিক জঙ্গলে চোরাশিকারিদের উপদ্রব রয়েছে। পরিবেশগত বাধায় পরিযায়ীদের জায়গা এখন আর নির্দিষ্ট থাকছে না। খুব চেনা জায়গাও বদলে ফেলছে তারা। জেলার এক বন আধিকারিকের কথায়, পরিযায়ী পাখিরা শীতের শুরু থেকেই জেলার বিভিন্ন জায়গায় আসতে শুরু করে। তারা তাদের দীর্ঘদিনের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ইদানীং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর দাবি, এর ফলে নজরদারিতেও সমস্যা হচ্ছে।
পাখিদের ঠাঁই বদলানোর অন্যতম নজির খড়্গপুরের চৌরঙ্গির কাছের জলাশয়। এক সময়ে এখানে পরিযায়ী পাখির দল আসত। পরে ওই জলাশয় বুজতে শুরু করে। পরিযায়ী পাখি আসাও কমতে শুরু করে। এখানে মূলত সারস আসত। কিছু এলাকায় নগরায়নের চাপে কমে গিয়েছে পরিযায়ীদের আনাগোনা। এই এলাকা তার বড় উদাহরণ। এ ক্ষেত্রে বন দফতরের ভূমিকা ঠিক কী? তারা কেন স্থানীয়দের সচেতন করে না? দফতর জানিয়ে দিচ্ছে, যে সব এলাকায় পরিযায়ীরা আসে, সেই সব এলাকায় বন দফতরের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচার করা হয়। নজরদারিও থাকে। এক আধিকারিক উদাহরণ দিয়েছেন, শালবনির কুলডিহাতেও এক সময়ে পরিযায়ী পাখিদের বিরক্ত করা হত। স্থানীয়রা সচেতন হয়েছেন। এখন আর কেউ ওই গ্রামে পাখিদের বিরক্ত করেন না। করার চেষ্টা করলে গ্রামবাসীরাই বাধা দেন। শীতে শালবনির এই গ্রাম অতিথি ভরা। শালবনির বিডিও সঞ্জয় মালাকার বলেন, ‘‘ওই গ্রামে পাখিরা নিরাপদেই থাকে। কেউ তাদের বিরক্ত করে না। পাখিদের আশ্রয় দিয়ে গ্রামটি একটি স্বতন্ত্র পরিচয় পেয়েছে।’’
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় শীত এলেই নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে। পূর্ব মেদিনীপুরে বেশ কয়েকটি জায়গায় পাখির আনাগোনা বেশ বেড়েছে। বন দফতর সূত্রে খবর, তাজপুরের কাছে একটি ঝিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। এছাড়া পাঁশকুড়ায়, কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ারের কাছেও পাখি আসে। হলদিয়ায় শালুকখালিতে একটি শিল্প সংস্থার ঝিলেও ইদানীং প্রচুর পাখি আসছে। তাছাড়া কুঁকড়াহাটি, নয়াচর, হলদিয়া টাউনশিপ এলাকার বন্দরের সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পের মধ্যেও নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি আসে। মূলত নানা ধরনের বক জাতীয় পাখিই বেশি আসে।
পূর্ব মেদিনীপুরের বন দফতরের ডিএফও স্বাগতা দাস জানান, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়েই রয়েছে নদী নালা খাল ও বিল। তাই এই জাতীয় পাখির আনাগোনা বেশি। তবে সব সময় খাদ্যের জন্য আসে না। এখানকার পরিবেশের কারণেও আসে। ইদানীং কুঁকড়াহাটিতে এক ধরনের পরিযায়ী পাখি আসছে দু’বছর ধরে। বেশির ভাগই বক জাতীয়। এই পাখি হুগলি নদীতে পারাপার করা লঞ্চের কাছেই খাদ্যের জন্য ঘোরাফেরা করে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি এরা চলে আসে। আর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকে। লঞ্চ যাত্রীদের ছুড়ে দেওয়া খাদ্য এরা সংগ্রহ করে। তবে সুতাহাটার বিভিন্ন গ্রামেও নানা জাতের বক আসে। এরা বন্দুকবাজদের অনেক সময় শিকার হয়। স্থানীয় বাসিন্দা সন্দীপন দাস, ধ্রুব সিমলাই জানাচ্ছেন, গ্রামের মধ্যে অনেকেই পাখি মারার বন্দুক নিয়ে শিকার করতে বেরিয়ে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার বলেও অনেকই মনে করেন।
এ ছাড়া হলদিয়া শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রের কাছে ড্রাই ডকেও প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। লোক চক্ষুর আড়ালে এদের মরতে হয় শখের বন্দুকবাজদের খপ্পরে পড়ে। বিজ্ঞানকর্মী সাহেব আলি খান জানান, ড্রাই ডকে ভোর রাতে কিছু লোক পাখি মারতে আসে। এদের থামানো উচিত। হলদিয়া শহরের ইন্ডিয়ান অয়েল এমপ্লিয়জ কো-অপারেটিভের কাছে দু’টি কাঁঠাল ও জামরুল গাছে অবশ্য প্রতি বছর কয়েকশো কালো মাথা বক আসছে। যদিও বন্দর আবাসনের বড় বড় গাছে পাখির সংখ্যা কমেছে। হলদি নদীর তীরে থাকা এই আবাসনে পাখি বসার জন্য উপযোগী ঝাঁকড়া ডালই কেটে দেওয়া হয়েছে। তাই বাসা বাঁধার অনুকূল পরিবেশ নেই। একই রকম ভাবে পাখি কার্যত নেই বালুঘাটার জঙ্গলেও। আগে সন্ধ্যা নামলেই এই জঙ্গল পাখির শব্দে মুখরিত হয়ে যেত। এখন শ্মশানের নীরবতা। ঝাড়গ্রামের ডিএফও বাসবরাজ হলাইচ্চি জানান, শীতের পাখিরা মূলত বেলপাহাড়ির খাদারানি আর গোপীবল্লভপুরে ঝিল্লিতে আসে। খাদারানিতে বোটিং হয় না। ঝিল্লিতে হয়। তবে পাখিদের নিরাপত্তার বিষয়টা দেখা হয়।
অর্থাৎ সমস্যা এখনও শেষ হয়নি। অতিথিরা এই বছরে কতটা স্বচ্ছন্দ হবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। জীববৈচিত্র পর্ষদের চেয়ারম্যান অশোক স্যান্যাল জানিয়েছেন, কিছু সমস্যা থাকলে তা ব্লক মনিটরিং কমিটিকে জানাতে। তারা সেই বিষয়ে পদক্ষেপ করবেন। তবে এর মধ্যেই নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদের সদস্য সুমন প্রতিহার জানাচ্ছেন, পশ্চিম মেদিনীপুরের কনকাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতের বাধাই গ্রামে কংসাবতীর পাড়ে পরিযায়ী পাখি আসে। গত বছরও তিনি চার রকমের মাছরাঙা, বিভিন্ন সরাল, ব্রাহ্মণী হাঁস (চখা-চখি), তিন ধরনের বক, বালি হাঁস, জিরিয়া, বাটান দেখেছেন। কিন্তু মাস ছয়েক আগে তিনি দেখে এসেছেন, কাঁসাইয়ের এই জায়গায় বাঁধ দিচ্ছে। এতে পাখিদের খাবার পেতে অসুবিধা হবে। স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন বেরা জানিয়েছেন, একসময়ে বহু পাখি তিনি এই অঞ্চলে আসতে দেখেছেন। এখন তত দেখেন না।
সুমন প্রতিহার একটি খবর দিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে রাজ্য জেলাভিত্তিক পরিযায়ী পাখিদের পরিসংখ্যান ও সুনির্দিষ্ট বিপদ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। সে নিয়ে রিপোর্টও জমা দিয়েছেন তিনি। মেদিনীপুরের রিপোর্ট জমা পড়েছে।
বিপদের খতিয়ান নেওয়া হচ্ছে। এতে হয়তো অতিথিদের বিপদ কমতে পারে। বিপদ চিনতে পারলে সমাধান তো সম্ভব।
তথ্য সহায়তা: বরুণ দে, আরিফ ইকবাল খান, কিংশুক গুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy