এমনই অবস্থা মেরিন ড্রাইভের কিছু অংশে। জলে ঢাকা গর্ত নজরে আসে না। — নিজস্ব চিত্র।
পুজোর আগেই দিঘার মুকুটে জুড়েছিল নতুন পালক— মেরিন ড্রাইভ। তার পর মুম্বইয়ের ধাঁচে সমুদ্রের কিনারা বরাবর তৈরি সেই রাস্তার আকর্ষণে দিঘা ছুটে গিয়েছেন বহু পর্যটক। কিন্তু মেরিন ড্রাইভে ছুটে চলার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়েছে অচিরেই। পুজোর সময় রাজ্যের অন্যান্য জায়গা থেকে যাওয়া পর্যটকদের অনেকেই ওই মেরিন ড্রাইভে ঘুরতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েছেন। অনেককেই আটকে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রশাসনের তরফে কোনও রকমের সাহায্য মেলেনি বলে উঠেছে বিস্তর অভিযোগ। স্থানীয়দের সাহায্যেই শেষমেশ বিপদ কাটিয়ে ফিরে এসেছেন তারা। প্রশাসন বিষয়টা জানে না এমন নয়। কী ভাবে রাস্তার কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তা খুলে দেওয়া হল, তা নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসকও সংশয়ে রয়েছেন।
১৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি ৩০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ এক সুতোয় জুড়ে দিয়েছিল দিঘা, শঙ্করপুর, তাজপুর এবং মন্দারমণিকে। পুজোর মুখে সেই মেরিন ড্রাইভের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উৎসবের মরসুমে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকেরা ভিড় জমিয়েছেন সৈকত শহরে। তাঁদের বেশির ভাগই মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ দেখতেও যাচ্ছেন গাড়ি নিয়ে। কিন্তু পর্যটকদের অভিযোগ, প্রায় ২৭ কিলোমিটার মসৃণ রাস্তা পেরিয়ে আচমকা তাঁদের ‘ধাক্কা’ খেতে হচ্ছে শঙ্করপুরের কাছে এসে। তাজপুর থেকে শঙ্করপুর যাওয়ার প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা ‘দুর্বিষহ’। পর্যটকদের অভিযোগ, ওই রাস্তায় নেই কোনও সতর্কতামূলক বোর্ড। যার ফলে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে সটান গর্তে ফেঁসে যেতে হচ্ছে তাঁদের। ওই রাস্তার কোথাও কোথাও সেই গর্ত প্রায় তিন ফুটের কাছাকাছি। গাড়ি এক বার ফেঁসে গেলে সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পর্যটকদের ছুটছে কালঘাম। এক তো গাড়ি উদ্ধার করতে সময় লাগছে বিস্তর। একই সঙ্গে গ্যাঁটের কড়ি যাচ্ছে জলের মতো।
গত বুধবার বেলঘরিয়া থেকে সপরিবার দিঘা গিয়েছিলেন রিপন সাহা। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি দিঘা থেকে শঙ্করপুর হয়ে তাজপুর যাচ্ছিলেন। শঙ্করপুর থেকে দেড় কিলোমিটার এগোতেই তাঁর গাড়ির সামনের একটি চাকা গর্তে পড়ে। রিপনের কথায়, ‘‘শঙ্করপুর থেকে এগোতেই রাস্তায় ছোটখাটো গর্ত দেখতে পাই। জল ভর্তি সেই সব গর্ত কতটা গভীর তার আন্দাজ পাচ্ছিলাম না। সরু জলকাদা ভর্তি রাস্তায় পিছনে ফিরে আসারও উপায় ছিল না। আমাদের পিছনেও অনেকগুলো গাড়ি ছিল। আচমকাই একটা গর্তে সামনের চাকা ফেঁসে গিয়ে গাড়িটা যেন মুখ থুবড়ে পড়ে রাস্তায়। কিছুতেই তোলা সম্ভব হয়নি। অন্য গাড়ি থেকেও লোকজন এসে ঠেলাঠেলি করে। কিন্তু গাড়ি তোলা যায়নি।’’ রিপনের অভিযোগ, সেই সময় পাশ দিয়ে পুলিশের একটি টহলদারি ভ্যানও যায়। কিন্তু তারা বলে, এখানে সাহায্যের কোনও ব্যবস্থা নেই। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের আর্তিতে পুলিশ কর্ণপাত করেনি। অগত্যা স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই গাড়ি উদ্ধার করতে হয়। ওঁরা ১২০০ টাকা চেয়েছিলেন। শেষমেশ হাজারে রফা হয়। শেষে জলকাদামাখা পোশাকেই দুর্বিষহ অবস্থায় রাতে কলকাতায় ফিরি।’’
একই অভিজ্ঞতা হাওড়ার আন্দুলের বাসিন্দা পঙ্কজ মণ্ডলের। তিনি বলেন, ‘‘দিঘায় আমরা আগেও বহু বার গিয়েছি। মন্দারমণি, তাজপুরেও। কিন্তু ঘুরপথে যাওয়ার জন্য এক এক বারে কেবলমাত্র একটা জায়গাতেই ঘুরেছি। এ বার মেরিন ড্রাইভের খবর শুনে দেখতে গিয়েছিলাম বৃহস্পতিবার। দিঘা থেকে খুব তাড়াতাড়িই শঙ্করপুর, তাজপুর বা মন্দারমণি যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শঙ্করপুর থেকে তাজপুরের কয়েক কিলোমিটার রাস্তা খারাপ হওয়ায় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আমাদের। বৃষ্টির জেরে এই অংশের রাস্তাও চূড়ান্ত খারাপ। আমাদের বড় গাড়ি ছিল বলে আটকে পড়লেও কিছু ক্ষণেই মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু ওই রাস্তায় বেশ কয়েকটি ছোট গাড়ি আটকে থাকতে দেখেছি।’’
স্থানীয় বাসিন্দা ঝর্না দাস বলেন, ‘‘রোজই সাত-আটটা করে ছোট গাড়ি আমাদের এই রাস্তায় আটকে যায়। গ্রামের ছেলেরাই দড়ি দিয়ে অন্য গাড়ির সঙ্গে বেঁধে তুলে দেয়। বাইরে থাকা ঘুরতে আসা মানুষদের তো এই রাস্তা সম্পর্কে কোনও ধারণা থাকার কথা নয়। প্রশাসনও খুব গুরুত্ব দেয় না। তাই আমরাই সচেতন করার চেষ্টা করি। আর ছেলেরা খেটেখুটে গাড়ি তুলে দিলে পর্যটকেরাই খুশি হয়ে ওদের মিষ্টি খাওয়ার টাকা দেন। আমরা চাই না। তবে যে গাড়ির সাহায্যে দড়ি দিয়ে তোলা হয়, তার চালককে কিছু পয়সা তো দিতেই হয়।’’
প্রশাসনের দাবি, গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় মন্দারমণি এবং শঙ্করপুরের মাঝের রাস্তাটি পুরোদস্তুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেচ দফতর এই রাস্তার মেরামতি চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত সমুদ্রবাঁধ সারাইয়েরও কাজ চলছে। ফলে রাস্তাটি চলাচলের একেবারেই অনুপযুক্ত। তা হলে সেই রাস্তা এত তাড়াতাড়ি খুলে দেওয়া হল কেন, উঠছে এই প্রশ্ন। বিষয়টি জানতে পরে ওই রাস্তায় সাময়িক ভাবে যান চলাচল বন্ধের আশ্বাস দিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে কাজ চলছে। রাস্তা বন্ধের জন্য বোর্ড লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কেন লাগানো হয়নি, জানতে চেয়েছি। এখন ওই রাস্তা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’
খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় প্রশাসনও। রামনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শম্পা মহাপাত্র বলেন, ‘‘পর্যটকদের এমন সমস্যা কাম্য নয়। রাস্তাটি বর্তমানে সেচ দফতরের তত্ত্বাবধানে মেরামতির কাজ চলছে। এমন একটা সময়ে রাস্তাটি পর্যটকদের জন্য খুলে রাখা ঠিক নয়। রাস্তাটি নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে যাতে পর্যটকদের গাড়ি চলাচল না করে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রাস্তার দু’দিকে সতর্কতামূলক বোর্ড দ্রুত লাগানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।’’
দিঘায় বেড়াতে গিয়ে খুব কম সময়ে প্রতিটি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই মেরিন ড্রাইভ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন মমতা। এই রাস্তার পরিকল্পনা দিঘার পর্যটন ব্যবসায় অক্সিজেন জোগাবে বলেও আশা। কিন্তু সেই পথের কিছু অংশই এখন ‘কাঁটা’ হয়ে উঠেছে পর্যটকদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy