অঙ্কন: কুণাল বর্মন।
বাঁশ পড়ছিল মণ্ডপের জন্য। পুজোর প্রস্তুতি। আর ছাপা শাড়িটার কথা মনে পড়ছিল মায়ের। গত বছর পুজোর সময়ে কিনে দিয়েছিল ছেলে। বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে দুর্গাপুজো হয় প্রতি বছর। এ বছরও হচ্ছে। পাড়ায় খুশির হাওয়া। সদ্য সন্তানহারা মায়েরা কি পারেন এ খুশিতে শামিল হতে!
সোমা মাইতি পূর্ব মেদিনীপুরের খাদিকুল গ্রামের বাসিন্দা। এগরা ১ ব্লকের জুমকি গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামটি কিছুদিন আগে দেশের খবরের শিরোনামে ছিল। ওড়িশা লাগোয়া এই গ্রামেই গত ১৬ মে কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগের বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল ১০ জনের। সোমা হারিয়েছিলেন তাঁর ছেলে অলোককে। মাত্র ২০ বছরের তরতাজা তরুণ।
খাদিকুল গ্রাম কৃষিনির্ভর। পানের বরজ আছে গ্রামের অনেকের। স্বামী গৌরাঙ্গ মাইতির একটা ছোট বরজ আছে। পানের চারা বসানোর মরসুম এখন। বরজে সে কাজই করছিলেন সোমা। বাইরে থেকে লোক এসেছে শুনে কাদা মাখা শাড়ি পরে বরজ থেকে বেরিয়ে এলেন রাস্তার ধারে। পরিচয় আর আসার উদ্দেশ্য শুনেই বাগ মানল না চোখের জল। হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন অলোকের মা। পুত্র শোকে কয়েক মাসেই ভেঙে পড়েছেন একেবারে। 'কেমন আছেন'? প্রশ্নের জবাবে মাঝবয়সি সোমা বলেন, ‘‘আর কিছুই নেই বাবা। লাখ টাকার সম্পত্তি (সন্তান) চলে গিয়েছে। শরীর, মন কোনওটাই আর চলে না।" কিন্তু পেট তো চালাতে হবে! শোকের উপর পাথর চাপিয়ে পানের চারার জন্য মাটি খোঁড়েন। বরজের পাটকাঠিগুলোকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠবে নতুন প্রাণ।
মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনেছেন অলোকের মা। বলছিলেন, ‘‘পুজোটা আসতে ছেলের কথা খুব বেশি করে মনে পড়ছে। বাড়ির পাশেই পুজো। গত বছর অমন দিনে আমার জন্য ছাপা শাড়ি নিয়ে এসেছিল।’’ তার পর যেন স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে বলে চলেন, ‘‘পরিবারের অভাব মেটাতে গিয়ে ছেলেটা আমার আগেই চলে গেল।’’ কথা বলতে বলতে শাড়ির আঁচল চলে যাচ্ছিল চোখে।
সোমার মতোই শোকে কাতর আরতি মাইতিও। ৭০ ছুঁইছুঁই আরতি রবীন্দ্রনাথ মাইতির (৪১) মা। রবীন্দ্রনাথও একই বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন। অলোক আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাইপো আর কাকা। পাশাপাশিই বাড়ি। বাড়ির ছোট ছেলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বামীকে বহুদিন আগেই হারিয়েছেন আরতি। সম্বল বলতে অ্যাসবেসটসের ছাউনি আর টিন দিয়ে ঘেরা একটি বাড়ি। ফাঁকা বাড়িতে ছেঁড়া কাঁথা পাতা রয়েছে মেঝেয়। এক পাশে বসে রয়েছেন বৃদ্ধা। বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভুগছেন। প্রথমে পাড়ার গ্রামীণ ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন। এগরায় গিয়ে হাসপাতালেও ডাক্তার দেখাচ্ছেন। তবু জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে না কিছুতেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধা বললেন, "বেঁচে থেকে লাভ কী! ছেলেটা আমার মধুসূধন। তার কিছুই নেই গো।’’
ছোট বৌমা, মৃত রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী গিয়েছেন অন্যের বাড়িতে পানের বরজে কাজ করতে। কাজ সেরে দুপুরে ফিরে এলে উনুনে হাঁড়ি চড়বে। ভাত হবে। তারপরেই দু’মুঠো খাবেন অসুস্থ বৃদ্ধা। তাতে আক্ষেপ নেই। বরং পরিস্থিতি বোঝেন তিনি। তাই বললেন, "মেয়েটা একাই লড়ে যাচ্ছে। লকডাউন আমার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। আগে তো ছেলেটা পানের বরজে কাজ করতে চলে যেত। কিন্তু কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল। লকডাউনের সময় বাড়ির পাশে বাজি কারখানায় কাজ হচ্ছিল। দিনমজুর হিসেবে দু’টো টাকা উপার্জন করতে পারবে ভেবেই সেখানে যেত। কিন্তু এভাবে যে প্রাণটা চলে যাবে সেটা আমরা কেউই ভাবিনি।’’
বিস্ফোরণের পরে রাজ্য সরকার পরিবার পিছু দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিল। আর একজনের চাকরি। সোমা এবং আরতিরা ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। অলোকের দাদা রণজিৎ হোমগার্ডের কাজ পেয়েছেন। কিন্তু কাগজপত্রে ত্রুটি থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথের পরিবার চাকরি পায়নি। দিন চলছে তবুও।
পুজো উপলক্ষে গ্রামে মেলা বসে প্রতি বছর। ঘরে ঘরে আত্মীয় স্বজনেরা আসেন। কিন্তু শুনশান রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট ঘরখানা। পুজোর আগে নতুন পোশাকও হয়নি কারও। রবীন্দ্রনাথে মা আরতি বলছেন, ‘‘ছেলে থাকলে দশটা টাকা দিত। সকলের সঙ্গে গিয়ে গ্রামের পুজো দেখতাম। আর কে দেবে আমায়!"
মেলা চলবে, বাজিও ফাটাবেন লোকজন। বাজির শব্দ কানে এলে শিউরে উঠবেন সোমা। বলছিলেন, ‘‘মনে হবে আবার কোনও নিজের লোককে হারিয়ে ফেলছি।’’
অঙ্কন: কুণাল বর্মন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy