ধৃতদের আদালতে তোলা হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র ranjan pal
‘ওর চালাকির উপর দিয়ে চালাকি করাই তো আমার উদ্দেশ্য’।
জয় বাবা ফেলুনাথে মগনলাল মেঘরাজের চালাকির উপর দিয়ে চালাকি করেছিলেন ফেলুদা। বাস্তবেও ঘটল তাই। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে মোবাইল টাওয়ার লোকেশন বারবার বদলেও লাভ হল না। নাম পরিচয় ভাঁড়িয়ে পুলিশকে ধোঁকা দেওয়া কিংবা মোবাইল সুইচড অফ করে তা প্রতিমার সিংহাসনের নীচে লুকিয়ে রাখার কৌশলও কাজে দিল না। কনস্টেবলের বুদ্ধিতে ভরসা রাখলেন সাইবার ক্রাইমের অফিসার। তাতেই কেল্লাফতে। প্রতারিত এক বৃদ্ধের লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে বেপাত্তা জামতাড়া গ্যায়ের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করল ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতেরা হল প্রিন্স কুশাওহা, সৌরভ মিত্র ও কিষাণ গরাই। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, কিষাণ জামতাড়া গ্যাংয়ের কো-অর্ডিনেটর। প্রিন্স এবং সৌরভ মোবাইল নম্বর জোগাড় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে ফোন করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলত। দলের সকলে সবাই কমিশন ভিত্তিক টাকার ভাগ পেত । প্রিন্স এবং সৌরভের বাড়ি পশ্চিম বর্ধমান জেলার কুলটি থানা এলাকায়। কিষাণ ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জামতাড়া জেলার কেলাহি গ্রামের বাসিন্দা। ধৃতদের কাছ থেকে দু’টি স্মার্টফোন, একাধিক সিম কার্ড, ব্যাঙ্কের চেকবই, অভিযুক্তদের একাধিক নামে তৈরি হওয়া আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড উদ্ধার করেছে পুলিশ।
অভিযুক্তদের ছবি নেই। তারউপর মোবাইলের টাওয়ার লোকশন বারবার বদলে ফেলায় সিদ্ধহস্ত জামতাড়া গ্যাংয়ের সদস্যেরা। এত সব প্রতিকূলতার মধ্যে পুলিশের ভরসা ছিল শুধু মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন। কিন্তু বারবার বদলে যাওয়া টাওয়ার লোকশনের কোনটা আসল কোনও নকল তা ধরাও বেশ কষ্টকর। তবু অভিযোগ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সাইবার ক্রাইমের চার সদস্যের দল। নেতৃত্বে সাব-ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি প্রামাণিক। গত শুক্রবার প্রথমে কুলটির কয়েকটি জায়গায় হানা দেন তদন্তকারীরা। কিন্তু মাছ জালে ওঠেনি। ফের আরেক দফা চেষ্টা। গত শনিবার দুর্গাপুরে একটি বাড়িতে গিয়ে হানা দেন তদন্তকারীরা। সেই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ফিরে যান তাঁরা। আশা প্রায় শেষ। তবে ফেরার পথে ওই দলের সদস্য এক কনস্টেবল জানান, দুর্গাপুরের বাড়িতে অভিযান যাওয়ার আগে তিনি বাড়ির মধ্যে একটি স্কুটি দেখেছিলেন। তার ছবিও তুলে রেখেছিলেন তিনি। এ কথা শোনার পরই স্কুটির নম্বর দিয়ে খোঁজখবর শুরু করেন তদন্তকারীরা। দেখা যায়, এক অভিযুক্তের নামে রয়েছে ওই স্কুটিটি। এক মুহূর্ত দেরি না করে ফের ওই বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। তখনই জেরার মুখে ভেঙে পড়ে প্রিন্স ও সৌরভ। তল্লাশিতে তদন্তকারীরা দেখেন, দু’জন মোবাইল সুইচড অফ করে তা প্রতিমার সিংহাসনের নীচে লুকিয়ে রেখেছিল।
চালাকির বাকি ছিল না কিছু। শুধু কাল হয়েছিল স্কুটি।
পুলিশ সূত্রে খবর, গত ১৫ এপ্রিল ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবার বাসিন্দা বছর পঁচাশির অরূপ রায়ের হোয়াটস্যাপে একটি মেসেজে আসে। সেখানে ২০ টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। মেসেজে জানানো হয়েছিল টাকা না দিলে রাতে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। ওই মেসেজ আসা ওই লিঙ্কে ক্লিকের পর বছর পঁচাশির অরূপের কাছে একটি ফোন আসে। ওই ফোনের নির্দেশ মত অরূপ মোবাইলে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করেন। বৃদ্ধ বলেন, ‘‘প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু ইলেকট্রিক মিটারের কনজিউমার নম্বর সঠিক বলার পরই বিশ্বাস হয়। ওদের নির্দেশ মত করার পর প্রথমে ২০ টাকা কেটে নেয়। তারপর হোয়াটসঅ্যাপ ব্লক করে দেয়।’’ সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের পরিজনেরা পাসবুক আপডেট করতে যান। পাসবইয়ে পাতা ছিল কম। পাসবই ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আপডেট হয়। পরের দিন ছিল রবিবার। ১৭ এপ্রিল ব্যাঙ্কে গিয়ে আপডেট করে অরূপ জানতে পারেন, চার দফায় মোট ১ লক্ষ ৪ হাজার ৯৪৭ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। সাইবার ক্রাইমে দ্বারস্থ হয়ে অভিযোগ জানান বৃদ্ধ।
ঝাড়গ্রাম সাইবার ক্রাইম থানার পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারেন বৃদ্ধের অ্যাকাউন্ট থেকে ওই টাকা কেরল, উত্তরপ্রদেশ, বাঁকুড়া ও মহারাষ্ট্রের চারটি পৃথক ব্যাঙ্ক থেকে তোলা হয়েছে। তদন্তের সূত্রেই প্রিন্স, সৌরভ ও কিষাণের নাম উঠে আসে। মোবাইলের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে, প্রিন্স ও সৌরভ দুর্গাপুরে এবং কিষাণ সালানপুরে রয়েছে। প্রিন্স ও সৌরভকে জেরা করে আসানসোলের সালানপুর কিষাণের বাড়িতে পৌঁছন তদন্তকারীরা। সে বাড়ির পিছন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। ধৃতদের বিরুদ্ধে প্রতারণার ধারায় মামলা হয়েছে। পরবর্তীকালে আইটি ধারায় মামলা রুজু করা হবে।
রবিবার ধৃত তিনজনকে ঝাড়গ্রাম আদালতে তোলা হয়। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী সজল মিত্র বলেন,‘বিচারক জামিন খারিজ করে ধৃতদের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি মামলার কেস ডায়েরি আদালতে ১২ মে তলব করেছেন।’’ ঝাড়গ্রামের ডিএসপি (ডিএনটি) সব্যসাচী ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা খুবই তাড়াতাড়ি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছি। ধৃতদের মধ্যে একজন জামতাড়া গ্যাংয়ের রয়েছে। পরবর্তীকালে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জামতাড়া গ্যাংয়ের মূল মাথাদের ধরার চেষ্টা করব। মানুষজনকে সচেতন হতে হবে, যাতে কেউ ফোনের নির্দেশ মত টাকা মেটানোর নামে অ্যাপ ডাউনলোড না করেন।’’
মগনলাল মেঘরাজেরা চিরকালই থাকে মেঘের আড়ালে। ঠিক যেমনটা ছিল প্রিন্স, সৌরভ, কিষাণ। এ ক্ষেত্রে দু’চাকাই হাতকড়া পরাল জামতাড়ার ত্রয়ীকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy