সামনেই পুজো। আনন্দপুরের অকুলসাড়া গ্রামের কুমোর পাড়ায় চলছে মঙ্গল ঘট তৈরির কাজ। — নিজস্ব চিত্র।
পুজো আসছে, তাই ব্যস্ত অকুলসাড়া। একটা গোটা গ্রাম, যেখানে সব পরিবার ভাগ করে নেন পুজোর কাজ। না, আনন্দপুরের অকুলসাড়া গ্রামে কোনও দিন দুর্গাপুজো হয়নি। অষ্টমীর সকালে একটু ঠাকুর দেখতে হলে যেতে হয় দু’কিলোমিটার দূরের এক পারিবারিক পুজোয়।
আসলে বাসিন্দারা সকলেই শিল্পী। কম-বেশি দু’শো পরিবারের বাস গ্রামে। কেউ প্রতিমা গড়েন, কেউ তৈরি করেন শোলার গয়না। আবার কেউ ঢাকি। অকুলসাড়ার কোণে কোণে তাই এখন পুজোর গন্ধ। গোটা গ্রাম ব্যস্ত পুজোর প্রস্তুতিতে।
গ্রামে ঢুকলেই এখন চোখে পড়ে বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হচ্ছে মাটির হাঁড়ি, মঙ্গলঘট। উঠোনে কি বাড়ির চালায় শুকোচ্ছে মাটির প্রদীপ, মালসা, থালা। প্রায় ৩০টি পরিবার মাটির কাজের সঙ্গে যুক্ত। কাজ করতে করতেই সন্ন্যাসী দাস, গৌর দাস, নিতাই দাসরা জানালেন পুরুষানুক্রমে তাঁরা এ কাজ করে আসছেন। এ সব জিনিসের বাজার থাকে সারা বছরই। কিন্তু পুজোর কাজে লাগে এমন মাটির জিনিসের জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম। বহু দূর থেকে পাইকাররা আসেন এই গ্রামে। কিনে নিয়ে যান দুর্গাপুজোর প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
মাটির রঙের পুজো আগমনী ছাড়িয়ে বেশি দূর হাঁটতে হবে না। একটু গেলেই চোখে পড়বে শোলার সাদা রঙ। মালাকার পাড়ায় দিন রাত এক করে তৈরি হচ্ছে চাঁদমালা, ডাকের সাজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল প্রায় ২০ টি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত শোলার কাজে। কিন্তু এখন আর সেই রমরমা নেই। শোলা শিল্পী গোপাল হালদার বলেন, ‘‘যে ভাবে দাম বেড়েছে শোলা, সে ভাবে আমাদের কদর বাড়েনি। বরং সস্তা জিনিসেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন পুজো উদ্যোক্তারা।’’ জিতেন হালদার জানালেন শোলা আনতে যেতে হয় সেই সবংয়ে। তার উপরে এক হাত মাপের এক টুকরো শোলার দাম ৪০ টাকা। সব খরচ বেড়েই চলেছে। খদ্দের বেশি দাম দিতে চান না। তবু কাজ করে চলেন ওরা। জিতেন হালদার, শ্যামলী হালদাররা নাওয়া খাওয়া ভুলে ব্যস্ত শোলার কাজে।
এই গ্রামেই বাস করেন কুমোরেরা। প্রায় ৩০ ঘর কুমোর আজও যত্নে গড়েন প্রতিমা। সেই রথের দিন থেকে চলে প্রস্তুতি। তিলে তিলে তিলোত্তমা গড়ে তাঁরা দিয়ে আসেন মণ্ডপে। শিল্পী দুর্লভ কর জানান, কয়েকটি ঘরে এখনও প্রতিমা তৈরি হয়। বায়না নিয়ে বারোয়ারি বা পারিবারিক পুজোর জন্য প্রতিমা তৈরি করেন তাঁরা নিজেদের বাড়িতেই। কিন্তু বেশির ভাগ শিল্পীই চলে যান বাইরে, কলকাতার কুমোরটুলিতে। তবে নতুন প্রজন্ম আর সে কাজে মন দেয় না। কারণটা সহজ— তেমন লাভ মেলে না।
গ্রামের শেষ প্রান্তে মুচিপাড়া। জেলা ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে যান মুচিপাড়ার বাসিন্দারা। পুজোর পাঁচটা দিন তাঁদের কদর আজও কম হয়নি যে। ‘‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ...’’ বোল তুলে মাতিয়ে রাখেন অকুলসাড়ার ঢাকিরা। গৌতম রুইদাস, উত্তম রুইদাসরা জানালেন এ বার তাঁদের বায়না এসেছে টাটা থেকে। রওনা দেওয়ার আগে চলছে শেষ প্রস্তুতি। ঢাকের চাম়ড়া গরম করে রাখা, বাজনার বোল আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়া কি নতুন ঢাক তৈরি— কাজ প্রায় শেষের পথে। মহালয়া এল মানেই তো সময় হয়ে গেল, জানালেন গৌতমবাবু।
এই গ্রামেই তৈরি হত বাজিও। নেহাতই ফুলঝুরি কি রং মশাল, তুবড়ি। উৎসবের আনন্দে অন্যদের আলোয় ভরে কয়েক টাকা রোজগার করতেন এখানকার বাসিন্দারা। কিন্তু এ বছর সে সব বন্ধ। অনিল খামরই, মানিক খামরুইরা জানালেন এবছর পুলিশ বাজি তৈরি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। হয়তো পিংলা-কাণ্ডেরই প্রভাব। পুজোর আনন্দ তাই একেবারে মাটি হয়েছে ওঁদের। ঘরের বাচ্চাগুলোকে একটা নতুন জামা কিনে দেওয়ার সাধ্যও নেই।
কষ্টটা চাপতে পারেন না অনেক চেষ্টা করেও। গ্রামের প্রায় সবাই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। কিন্তু গ্রামে হয় না কোন বারোয়ারি পুজো। প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম গড় সোনাপোত্যার দেব বাড়িতে পুজো হয়। সেখানেই ভিড় জমায় গ্রামের ছোটরা। আর আছে খেতুয়ার বারোয়ারি পুজো। অকুলসাড়া থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের বাসিন্দা কল্পনা রুইদাসের কথায় স্পষ্ট হয়ে যায় সত্যিটা, ‘‘গ্রামের মধ্যে পুজো হবে কী করে? সেই সাধ্য আছে না কি! গোটা গ্রামে মাত্র তিনজন চাকরি করেন। পুজোর খরচ দেবে কে?’’ বছর চোদ্দোর তুফান, গোবিন্দরাও জানে এই সত্যিটা। ওরা কেউ কেউ অবশ্য কলকাতার পুজো দেখেছে, বাবার সঙ্গে ঢাক বাজাতে গিয়ে। কিন্তু নিজেদের গ্রাম পুজোর ক’দিন অন্ধকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy