কোচপুকুর অবৈতনিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের রান্নাঘর। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার, তার হদিস মিলল ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই।
বাংলার স্কুলে স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্পের হালহকিকত খতিয়ে দেখতে আসা কেন্দ্রীয় দলের পরিদর্শনের সময় সোমবার দেখা গিয়েছিল, যাঁরা রান্না করছেন, তাঁদের পরনে মাস্ক, টুপি, গ্লাভস, এমনকি অ্যাপ্রনও। কলকাতার উপকণ্ঠে রাজারহাট এলাকার সেই সব স্কুলের রান্নাঘরও ঝাঁ-ঝকঝকে। সেটা যদি প্রদীপ হয়, মঙ্গলবার সেই এলাকারই অন্য স্কুলে দেখা গেল অন্ধকার। দেখা গেল, সেখানে পড়ুয়াদের জন্য খাবার তৈরির রান্নাঘর মলিন। অ্যাপ্রন, গ্লাভস, টুপি বা মাস্কের নামগন্ধ নেই রন্ধনকর্মীদের। সোমবার রান্নাঘর ও রন্ধনকর্মীদের অত্যুজ্জ্বল সাজসজ্জা যতটা আকস্মিক ও অস্বাভাবিক ঠেকেছিল, মহানগরীর অদূরের স্কুলে এ দিন যে-মলিনতা স্পষ্ট হল, তা-ও সমান বিস্ময়কর।
আগাম জানান দিয়ে কনভয় নিয়ে সোমবার রাজারহাটের বনমালীপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি স্কুলে পৌঁছে গিয়েছিল দিল্লির ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল। সেখানেই দেখা গিয়েছিল পরিপাটি রান্নাঘর, ধুয়ে রাখা ঝকঝকে বাসনপত্র-সহ রন্ধন সরঞ্জাম, মাস্ক-অ্যাপ্রন-গ্লাভস-টুপি পরে থাকা মিড-ডে মিল রাঁধুনিদের। এ দিন সাড়ে ১২টায় রাজারহাটেরই থাকদাঁড়ি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলের রান্নাঘরে পৌঁছে দেখা গেল, রান্নায় ব্যস্ত দুই কর্মীর অ্যাপ্রন, টুপি, গ্লাভসের বালাই নেই। কেন নেই, প্রশ্ন করায় কর্মীরা জানালেন, সবই রাখা আছে। ভাত হয়ে গেলে, ডিমের ঝোল রান্নার আগে অ্যাপ্রন আর গ্লাভস পরে নেবেন। তত ক্ষণে রান্নাঘরে পৌঁছে গিয়েছেন স্কুলের শিক্ষকেরা। তাঁদের দাবি, ‘নিয়ম মেনেই’ মিড-ডে মিল রান্না করা হয়। সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হাজির, এটা জানতে পেরে রাঁধুনিদের দ্রুত অ্যাপ্রন পরার নির্দেশ দিলেন তাঁরা। এমনকি, অ্যাপ্রন না-পরে রান্না করার কোনও ছবি তোলা হয়ে থাকলে তা ডিলিটও করে দিতে বললেন।
একটু দূরে কোচপুকুর অবৈতনিক বিদ্যালয়ের রান্নাঘরে দুই মহিলা রান্না করছিলেন মাস্ক, অ্যাপ্রন, গ্লাভস ছাড়াই। রান্নাঘরের দেওয়ালে কালির ছোপ। অঙ্গনওয়াড়ির রান্না এখনও হয় কাঠের উনুনে। বাসনপত্র ধুতে হয়, তাই গ্লাভস পরেননি বলে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা অ্যাপ্রন না-পরার যুক্তি দেখালেন— ‘গরম লাগে।’
নিকটবর্তী ধর্মতলার পাঁচুড়িয়া অবৈতনিক বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের খাবার নিয়ে বারান্দাতেই খেতে বসেছে পড়ুয়ারা। যে-সব রাঁধুনি ও রন্ধনকর্মীরা খেতে দিচ্ছিলেন, তাঁদের গ্লাভস নেই, বালাই নেই মাস্কেরও।
মিড-ডে মিল পরিদর্শনে আসা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের বেশ কয়েক দিন রাজ্যে থাকার কথা। তারা যে-কোনও সময়েই পৌঁছে যেতে পারে যে-কোনও স্কুলে। তাই শিক্ষা দফতর থেকেও মিড-ডে মিলের রান্নায় বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে বলে জানান শিক্ষকেরা। তবু কেন এই অসচেতনতা, এত শিথিলতা কেন— সেই প্রশ্ন উঠছে। ঠিক যেমন সোমবার প্রশ্ন উঠেছিল, রান্নাঘর ও রন্ধনকর্মীদের নিশ্চয়ই সাফসুতরো থাকতে হবে, কিন্তু বাড়তি ঝকমকানি কি প্রশ্ন বাড়িয়ে দেয় না?
পশ্চিম মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এ দিন পরিদর্শন হয়েছে। চার মহিলা আধিকারিক-সহ পাঁচ সদস্যের দল পৌঁছয় পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার ব্লক প্রশাসনিক কার্যালয়ে। জেলা সদর মেদিনীপুরের পরিবর্তে সরাসরি ব্লকে গিয়ে আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক সেরে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা যান ধামতোড় বিল্বেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মিড-ডে মিলের যাবতীয় নথি দেখতে চান। ঢুকে পড়েন স্কুলের রান্নাঘরেও। রাঁধুনিদের সঙ্গে কথা বলেন। পড়ুয়া পিছু কতটা চাল, ডাল নেওয়া হয়েছে জানতে চান। চালের নমুনাও সংগ্রহ করেন। পরে কেন্দ্রীয় দল যায় নারায়ণগড় ব্লকে। সেখানে কুশবসান হাইস্কুলে প্রথমে ঢুকে মিড-ডে মিল খেয়ে দেখেন দলের এক সদস্যা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের পিকে হাই স্কুলে একই ভাবে রাঁধুনিদের সঙ্গে কথা বলেন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা। রান্নার উপকরণ ও বাসনপত্র পরীক্ষা করেন। কী ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় তা খতিয়ে দেখে স্কুল পড়ুয়া ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন।
আজ, বুধবার জলপাইগুড়ি পৌঁছবে কেন্দ্রীয় দল। তার আগে রান্নাঘরের দেওয়ালে মিড-ডে মিলের চিহ্নের নীচে ‘পিএম পোষণ’ লিখতেই হবে, নির্দেশ এসেছে জেলায়। সেই মতো রং পেনসিল দিয়ে অনভ্যস্ত হাতে লেখা হয়েছে করলার চর প্রাথমিক স্কুলে। প্রধান শিক্ষকের স্বীকারোক্তি, “এত অল্প সময়ে লেখানোর জন্য শিল্পী পাব কোথায়?” তবে অস্বস্তি লুকিয়ে চালের ড্রামে। জেলাশাসকের দফতর থেকে কিছুটা দূরে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাঁড়ারে স্টিলের ড্রামে চালে কালো পোকা ঘুরছে। মিড-ডে মিল রান্নার দায়িত্বে থাকা গীতা ঘোষ বলছেন, “পোকা বেছেই রান্না করি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy