কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রকাশিত মাওবাদী ‘উপদ্রুত’ জেলার তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের শুধু ঝাড়গ্রাম জেলার নাম রয়েছে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
দেশের ১০টি রাজ্যে মাওবাদী গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে অবশেষে কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ঘটনাচক্রে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেই সাফল্যের ছবি সবচেয়ে ‘উজ্জ্বল’। কিন্তু তার মধ্যেও কাঁটার মতো খচখচ করছে ঝাড়গ্রাম। এখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘উপদ্রুত’ তালিকায় রয়েছে বাংলার এই জেলা। অনেক বছর সেখানে কোনও নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। তা-ও কেন ঝাড়গ্রাম ‘উপদ্রুত’?
সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে তিন সাংসদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন দেশের মধ্যে বাম উগ্রপন্থা (মাওবাদী) প্রভাবিত জেলাগুলির বিষয়ে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তাঁর জবাব বলছে, ২০১০ সালে ১০টি রাজ্যের ১২৬টি জেলা বাম উগ্রপন্থার কারণে ‘উপদ্রুত’ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এখন সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩৮-এ।
এখনও ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই রাজ্যের ১৫টি জেলা এখনও ‘উপদ্রুত’। দ্বিতীয় স্থানে ওড়িশা। সেই রাজ্যের ৭টি জেলা এখনও ‘উপদ্রুত’ তালিকায়। তৃতীয় ঝাড়খণ্ড। কারণ, সেখানকার ৫টি জেলায় এখনও মাওবাদী উপদ্রব রয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্র। উপদ্রব সবচেয়ে কম পশ্চিমবঙ্গে। তার মধ্যেও মাত্র একটি জেলার নাম ‘উপদ্রুত’ তালিকায়।
কেন ঝাড়গ্রামের নাম এখনও ‘উপদ্রুত’ তালিকায় রয়ে গেল, সেই প্রশ্নের জবাবে ঝাড়গ্রাম জেলার পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘আমরা সতর্ক রয়েছি। আমাদের নজরদারি নিরন্তর চলছে। জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনীও রয়েছে। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া রেখেই জেলা পুলিশ কাজ করছে। যে ক্ষেত্রে যে রকম অভিযানের প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে তেমনই করা হচ্ছে।’’ তবে কাদের উপরে নজরদারি, কী ধরনের অভিযান, তা নিয়ে বিশদে কিছু জানাননি তিনি।
২০১০ সালে মাওবাদী হানায় দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছিল। নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ নাগরিক মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল মোট ১,০০৫। তখন পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জেলাকে ‘উপদ্রুত’ বলে তালিকায় রাখা হয়। সেগুলি হল ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং বীরভূম। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ঝাড়গ্রাম ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আর কোনও জেলা আর মাওবাদী ‘উপদ্রুত’ নয়।
শাহের মন্ত্রক সেই ‘কৃতিত্ব’ কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যগুলিকেও দিয়েছে। সংসদে জানানো হয়েছে, বাম উগ্রপন্থা নির্মূল করার যে জাতীয় নীতি ও অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৫ সালে তৈরি হয়েছিল, কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি তা নিষ্ঠার সঙ্গে রূপায়িত করেছে। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্বীকার করে নিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী ‘উপদ্রুত’ জেলার সংখ্যা ৫ থেকে কমে ১ হওয়ার নেপথ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তালিকায় ঝাড়গ্রামের নাম এখনও থেকে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলার যে চার জেলা আগে ‘উপদ্রুত’ তালিকায় ছিল, সেগুলির সঙ্গে ঝাড়গ্রামের পরিস্থিতির আপাতদৃষ্টিতে খুব ফারাক চোখে পড়ে না। কিন্তু অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারেরা জানাচ্ছেন, যে সব সূচকের উপর ভিত্তি করে ‘উপদ্রুত’ তকমা নির্ধারিত হয়, তা অনেক সময়েই আপাতদৃষ্টিতে নজরে আসে না। ‘হিংসাত্মক ঘটনা’, ‘উগ্রপন্থী কার্যকলাপ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য’ এবং ‘গণসাংগঠনিক কার্যকলাপ’— এই তিন সূচকের উপরে দাঁড়িয়ে কোনও জেলাকে ‘উপদ্রুত’ তকমা দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। স্থানীয় সূত্র বলছে, ২০১১ সালে বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষেনজির ‘এনকাউন্টার’-এর পর থেকে এলাকায় দ্রুত কমতে থাকে মাওবাদী কার্যকলাপ। পরে রাজারাম, জাগরী বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতোদের মতো প্রথম সারির মাওবাদী নেতা-নেত্রীদের আত্মসমর্পণ ঝাড়গ্রাম-সহ জঙ্গলমহলের সব জেলাতেই মাওবাদী কার্যকলাপে রাশ টানে। ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশের সূত্র বলছে, ২০১৩-’১৪ সালের পরে মাওবাদীরা আর কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঝাড়গ্রামে ঘটাতে পারেনি। তার পরেও তিন-চার বছর ধরে ঝাড়গ্রাম থেকে মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ চলেছে। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই মাওবাদীদের তৈরি বিভিন্ন গণসংগঠনেরও আর ঝাড়গ্রামে দেখা মেলে না।
যদিও ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ঝাড়গ্রাম জেলার বেশ কিছু এলাকায় ‘মাওবাদী’ পোস্টার পড়েছিল। তবে পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, সিপিআই (মাওবাদী)-এর নাম করে পোস্টার লাগিয়ে টাকা তোলার চেষ্টা হচ্ছিল। সেই ঘটনায় ৩০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু যে হেতু ধৃতেরা ‘আসল’ মাওবাদী নয়, তাই ঝাড়গ্রাম জেলার ‘উপদ্রুত’ তকমা বহাল থাকার সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই বলেই মনে করছে প্রশাসনিক মহল। তা হলে কেন ঝাড়গ্রামকে এখনও ‘উপদ্রুত’ বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক?
পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ যখন তুঙ্গে, তখন বিভিন্ন ‘কমিটি’র জন্ম হয়েছিল। কখনও জনসাধারণের কমিটি, কখনও জমিরক্ষার নামে কমিটি, কখনও শালবন রক্ষার নামে কমিটি। এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে তৈরি করা ওই কমিটিগুলি আসলে মাওবাদীদের ‘গণসংগঠন’ হিসেবে কাজ করত বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। ওই সূত্রের আরও বক্তব্য, সিপিআই (মাওবাদী) প্রকাশ্যে কোনও কার্যকলাপে যোগ দিতে পারত না। ফলে ওই গণসংগঠনগুলির মাধ্যমে জনসংযোগের কাজ করতেন মাওবাদী নেতৃত্ব। এই সব গণসংগঠনের গতিবিধিও জেলাকে ‘উপদ্রুত’ তালিকায় রাখার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে কাজ করে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ওই বিষয়ে কী রিপোর্ট দিচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। তেমন কিছু রিপোর্ট ঝাড়গ্রামের প্রসঙ্গে গিয়েছে কি না, জঙ্গলের আড়ালে গণসংগঠন গড়ে আবার অতীতের ‘বন পার্টি’ সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে কি না, আপাতত সেই জবাবই খুঁজছে রাজ্য প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy