—প্রতীকী ছবি।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন রাজ্যের প্রসূতি মৃত্যুর অনুপাত (‘মেটারনাল মর্টালিটি রেশিয়ো’ বা এমএমআর) ১০৩। প্রতি এক লক্ষ জীবিত সন্তান প্রসবের নিরিখে এই হিসেব রাখা হয়। গোটা বিশ্বে সামগ্রিক ‘এমএমআর’ ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৭০ বা তার নীচে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে এ রাজ্যে তিন মাসে এমন অনুপাত দেখে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্যকর্তারা। আর স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত তিন মাসে যত প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগের বয়স ১৮ বছর বা তার নীচে। গত তিন মাসে শহর এবং প্রত্যেক জেলার কোনও না কোনও মেডিক্যাল কলেজ বা জেলা সদর হাসপাতালে সিজ়ারের পরে অনেক প্রসূতির অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ছে এবং মৃত্যুও ঘটছে।
সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে ওষুধের গুণগত মান ঠিক না থাকায় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি উঠে এলেও, সেটিকেই এক মাত্র কারণ বলে মানতে চাইছেন না দফতরের শীর্ষ কর্তারা। বরং, সিনিয়র স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকদের উপস্থিতি, নাবালিকা প্রসূতি এবং অপারেশন থিয়েটার কতটা সংক্রমণ মুক্ত, সেই বিষয়গুলিও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছে স্বাস্থ্য ভবন।
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক জানান, সংক্রামক রোগ, স্ত্রী-রোগ, ক্রিটিক্যাল কেয়ার এবং নেফ্রোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে তাঁরা রিপোর্ট দেবেন। সূত্রের খবর, ‘স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’-এর রিপোর্ট (২০১৮-২০) অনুযায়ী দেশের সার্বিক ‘এমএমআর’ ছিল ৯৭। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ছিল ১০৩। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ২০২০-র পরে, এখনও পর্যন্ত প্রসূতি মৃত্যুর অনুপাত সরকারি ভাবে প্রকাশিত হয়নি। তবে প্রতিটি রাজ্য নিজস্ব হিসেব রাখে। সেই সূত্রে এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের খবর, ২০২৩-২৪ আর্থিক বর্ষে প্রসূতি মৃত্যুর অনুপাত ৯৬-৯৭-এ নেমে গিয়েছিল। কিন্তু চলতি আর্থিক বছরের শুরুতে সেই ছবিটায় বড়সড় ধাক্কা এসেছে বলে পর্যবেক্ষণ স্বাস্থ্য ভবনের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, প্রতি এক লক্ষ জীবিত সন্তান প্রসবের নিরিখে প্রসূতি মৃত্যুর অনুপাত নির্ধারণ করা হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ‘‘সেই হিসেবেই এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মোট যত জীবিত সন্তান প্রসব হয়েছে, সেটির সঙ্গে মায়ের মৃত্যুর হিসেব কষে প্রতি লাখে এই অনুপাত নির্ণয় করা হয়েছে।’’ প্রবীণ স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক তরুণকুমার ঘোষের মতে, ‘‘স্বাভাবিক প্রসব ও সিজ়ারের মধ্যে কোনটির সংখ্যা বেশি, সেটা দেখা খুব জরুরি। অনুপাত এতটা বেশি কেন তা খতিয়ে দেখে দ্রুত সমাধানের পথ বার না করলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হতে পারে।’’
স্বাস্থ্য ভবনের সূত্র বলছে, বিভিন্ন জায়গা থেকেই খবর মিলছে জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শিক্ষক-স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদের অধিকাংশই সপ্তাহে এক বা দেড় দিন হাজির থাকছেন। ফলে এক জন প্রসূতির চিকিৎসায় নির্দিষ্ট চিকিৎসক মিলছে না। আবার, অনেক ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর পড়ুয়ারা অস্ত্রোপচার করছেন। শিক্ষক-চিকিৎসকের কোনও তত্ত্বাবধানই থাকছে না। যদিও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের নিয়মে বলা আছে, স্ত্রীরোগ বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের প্রথম বর্ষের পড়ুয়ারা অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়ারা সিজ়ারে সহযোগিতা করতে পারেন এবং তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়ারা কিছু ক্ষেত্রে, শিক্ষক-চিকিৎসকের উপস্থিতিতে অস্ত্রোপচার নিজে হাতে করতে পারবেন। বাস্তবে প্রায় কোনও জায়গাতেই তা মানা হচ্ছে না। অস্ত্রোপচার পরবর্তী পর্যবেক্ষণেও বড়সড় খামতি থেকে যাচ্ছে বলেই মত স্বাস্থ্য ভবনের।
সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস জানাচ্ছেন, প্রসূতি-মৃত্যুর হার দেশ তথা রাজ্যেরও সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সেই সূচকে ফলাফল খারাপের অর্থ হল সংশ্লিষ্ট রাজ্যে সামগ্রিক ভাবে অপুষ্টি, নাবালিকা বিবাহ, সচেতনতার অভাব। ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫’ (২০১৯-২০২০) দেখা গিয়েছিল, এ রাজ্যে নাবালিকা বিয়ের হার সার্বিক ভাবে (শহর ও গ্রাম মিলিয়ে) প্রায় ৪২%। সেটি আরও বৃদ্ধির কারণে প্রসবকালীন মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে বলে মত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য শিবিরের উদ্বেগের আরও কারণ— প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই তিন মাসে রাজ্যে প্রসবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সেই তুলনায় গত তিন মাস প্রসবের সংখ্যা কম। তাতেই এমন অবস্থা। চলতি মাসের প্রথমে রাজ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানো নিয়ে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ ও জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করে স্বাস্থ্য ভবন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, প্রসূতি মৃত্যু কমাতে প্রতিটি জেলার দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতালে (জেলা, মহকুমা হাসপাতাল) ‘মনিটরিং’ দল পাঠানো হবে সেখানকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে। কিন্তু রাজ্যে মাতৃ বা প্রসূতি মৃত্যুর সার্বিক হারের৯০ শতাংশ যেখানে মেডিক্যাল কলেজে ঘটছে, সেখানে নজরদারি চালাবেন কারা? সদুত্তর মেলেনি স্বাস্থ্যকর্তাদের থেকে।
অন্য দিকে, প্রসূতিদের ব্যবহৃত স্যালাইন ও ওষুধের গুণগত মান নিয়েও সংশয় ঝেড়ে ফেলতে রাজি নয় স্বাস্থ্য শিবিরের একাংশ। বরং অভিযোগ, সরবরাহ অনেকটা কমে যাওয়ায় অনেক ওষুধের গুণগত মানের পরীক্ষার ফলাফল আসার আগেই তা ব্যবহার করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy