Advertisement
০৭ অক্টোবর ২০২৪
R G Kar Issue

অনশনে ‘সিনিয়র’ মমতার বিরুদ্ধে অনশনে ‘জুনিয়র’ ডাক্তারেরা! তাঁরই অস্ত্র তাঁর দিকে ধাবিত ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে

রাজ্যে অনশন আন্দোলন বললেই উল্লেখ করতে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। ধর্মতলায় টানা ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি। এখন তাঁর ‘অস্ত্র’ই বেছে নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।

Many time CM Mamata Banerjee faces her own political weapon hunger strike in last 13 years

(বাঁ দিকে) ২০০৬ সালে ধর্মতলায় অনশনরত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চ (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:১৮
Share: Save:

নিজে টানা অনশন করেছেন। অনেক অনশন ভেঙেওছেন। কিন্তু এ বার নিজেরই ‘অনশন অস্ত্রের’ মুখোমুখি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যে পথে ‘রাজনৈতিক সাফল্য’ পেয়েছিলেন, সেই পথই বেছে নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁরই সরকারকে বেগ দিচ্ছে। বিরোধী নেত্রী মমতা যে অস্ত্রে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারকে বিপাকে ফেলেছিলেন, সেটাই এখন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে!

বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মাঠ-ময়দানের রাজনীতিই ছিল মমতার স্বভাবসিদ্ধ। রাজনীতির পথ হিসাবে বার বার পথকেই বেছেছেন তিনি। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে জাতীয় সড়কে মঞ্চ বেঁধে ২১ দিন একটানা পড়ে থেকেছেন। মমতার পথের রাজনীতির উদাহরণ অনেক। তবে আন্দোলনের অনেক মাইলফলকের মধ্যে উজ্জ্বলতম ২০০৬ সালে মেট্রো চ্যানেলে টানা ২৬ দিনের অনশন। সেই আন্দোলনে প্রবল চাপে পড়তে হয়েছিল তখনকার বামপন্থী শাসকদের। জাতীয় রাজনীতির আলোও কেড়ে নিয়েছিল মমতার সেই অনশন।

ঘটনাচক্রে, তার থেকে বড়জোর ৫০ মিটার দূরত্বে মঞ্চ বেঁধে আমরণ অনশনে বসেছেন জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে সাত জন। তাঁদের ১০ দফা দাবির সমর্থনে। তাঁরা জানাচ্ছেন, দাবি পুরোপুরি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই অনশন চলবে। অনশন শুরু হয়েছে শনিবার রাতে। সোমবার বিকালে তাঁদের অনশন তুলে নেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তিনি বলেছেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে যাবে। এখন দেখার, সেই আর্জি মেনে জুনিয়র ডাক্তারেরা অনশন তুলে নেন কি না।

প্রসঙ্গত, ক্ষমতায় আসার পরে মমতাকেও বারংবার তাঁরই দেখানো অনশন অস্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ এবং তার সঠিক তদন্তের দাবিতে যাদবপুরে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। ঘেরাও থেকে মুক্তি পেতে পুলিশ ডাকেন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। এক রাতে ক্যাম্পাসে ঢুকে বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের ব্যাপক মারধর করে পুলিশ। এর পরেই উপাচার্যের ইস্তফার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অনশনে বসেন একদল পড়ুয়া। অনশন কয়েকদিন চলার পরে মমতা নিজে পৌঁছেছিলেন যাদবপুরে। উপাচার্যের ইস্তফার বিনিময়ে অনশন তুলিয়েছিলেন তিনি।

২০১৫ সালেরই ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর পরীক্ষায় পাশ করে শিক্ষক পদপ্রার্থীরা অনশনে বসেন। সেই সঙ্গে চুক্তি-শিক্ষক, বৃত্তি-শিক্ষক, পার্শ্বশিক্ষক-সহ শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত কর্মী সংগঠনের অনশন-আন্দোলন শুরু হয় কলকাতা জুড়ে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় চেষ্টা করেন অনশন তোলার জন্য। মমতা সে বার অনশনের থেকে আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সাংবাদিক বৈঠক করেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী দেখছেন। তিনিই যা বলার বলবেন। তবে আজকাল কিছু হলেই কথায় কথায় লোকে অনশন করেন। যাঁরা করেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।”

সেই বছরেরই অক্টোবরে হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারে মুসলিম ইনস্টিটিউটের কাছে অনশন শুরু করে মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন। তবে সেটা ‘রিলে অনশন’ ছিল। তাতেই কয়েক জন শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনশনে যোগ দিয়ে বাড়ি ফিরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্রের (এমএসকে) সহ-শিক্ষিকা ছন্দা সাহার। তবে ৪৯৭টি এমএসকে-কে মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের আওতায় আনা এবং নিয়মিত শিক্ষকদের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দাবিতে সেই অনশন সামলে দিয়েছিলেন তখন তৃণমূলের সক্রিয় নেতা মুকুল রায়।

তবে মমতাকে বেগ পেতে হয়েছিল ২০১৯ সালের মার্চ মাসে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের অনশনে। মেধাতালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে— এই দাবিতে মেয়ো রোডে অনশনে বসেন হবু শিক্ষকেরা। সেই আন্দোলনে প্রায় ৮০ জন এসএসসি চাকরিপ্রার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে বারেও মমতা চলে যান অনশন মঞ্চে। বলেন, ‘‘আমার পুরোপুরি সহমর্মিতা আছে আপনাদের প্রতি। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। অনশন তুলে নিন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সেই আশ্বাসে কাজ হয়েছিল। উঠে যায় অনশন। ২০১৯ সালের অগস্টে পার্শ্বশিক্ষকেরা অনশনে বসার সিদ্ধান্ত নিলেও প্রশাসন তা হতে দেয়নি।

কিন্তু মমতার নিজের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে রয়ে গিয়েছে ধর্মতলার মঞ্চে তাঁর অনশন। টানা তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও বিভিন্ন বক্তৃতায় মমতা বিরেোধী নেত্রী থাকাকালীন তাঁর যে অনশন আন্দোলনের কথা বার বার উল্লেখ করেন।

যদিও বিজেপি মমতার অনশনের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে এক করে দেখতে চাইছে না। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘‘ওটা অনশন ছিল না কি! রাতে পর্দার আড়ালে কী হত তা নিয়ে তো ওঁর দলের লোকেরাই নানা কথা বলেন। এখন যে অনশন চলছে, তার সঙ্গে রয়েছে গোটা রাজ্যের মানুষের সমর্থন।’’ একই সঙ্গে সুকান্তের দাবি, ‘‘অনশনকে মমতার ‘অস্ত্র’ বললে আন্দোলনের এই পথকে অসম্মান করা হবে। অনশনের অনেক ঐতিহাসিক নজির রয়েছে আমাদের দেশে।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘পাহাড়ে ওঠার সময়ে মনে রাখতে হয় যে, ওই পথেই ফিরতে হবে। তাই আশপাশকে অসম্মান করা ঠিক নয়। যেমন করেছেন, তেমন ফল পাচ্ছেন।’’ যার পাল্টা রাজ্যের মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘খেয়েদেয়ে চার ঘণ্টা রিলে অনশন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হওয়া যায় না। তার জন্য বামফ্রন্ট বা সিপিএমের মতো নিষ্ঠুর শাসকের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক লড়াই করতে হয়। মনে হল অনশন করব আর বসে পড়লাম! আর সিপিএম পিছন থেকে মদত দিতে নেমে পড়ল। এ সব করে আর যা-ই হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলা করা যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE