বাড়িতে পড়াশোনায় ব্যস্ত নাজমিন নাহার। নিজস্ব চিত্র
বুধিয়া হাই মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ে নাজমিন নাহার। মালদহের ইংরেজাবাজার ব্লকের গ্রাম বুধিয়া। নাজমিনের বাবা মজিবর রহমান দিনমজুর, মা আসেনুর বিবি বিড়ি বাঁধেন। নামটুকুও সই করতে পারেন না তাঁরা। স্মার্ট ফোন কেনার ক্ষমতা নেই। মজিবরের হাত দিয়ে যে প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিল মাদ্রাসা, সেখানে বীজগণিতে এসে হোঁচট খেয়েছে মেয়েটি। কার কাছে যাবে সে অঙ্ক বুঝতে? শিক্ষককে ফোন করা যেতে পারে। কিন্তু ফোনে বীজগণিত বোঝা যে খুব কঠিন তার কাছে। তাই নাজমিন বসে আছে মাদ্রাসা খোলার অপেক্ষায়।
পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদে হরিহরপাড়ার পদ্মনাভপুর হাই মাদ্রাসার ছাত্রী ইসমা খাতুন। পড়ে দশম শ্রেণিতে। বছর ঘুরলেই হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা। ইসমার কথায়, ‘‘লকডাউনে বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তাই নিজে যা পারছি, সে ভাবেই উত্তর লিখছি।’’ ওই হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘মাদ্রাসার ৭০ শতাংশের বেশি অভিভাবকই পড়াশোনা জানেন না। বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেবে কে?’’ এই সার কথাটি বললেন মুর্শিদাবাদের গোবরগাড়ার এক ছাত্রীর বাবা মাইনুদ্দিন শেখও: ‘‘মেয়েকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে স্কুল থেকে প্রশ্নপত্র এনে দিয়েছি।’’ বাঁকুড়ার রসুলপুরে ভ্যানচালক হুমেদ আলি তরফদারের মেয়ে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। হুমেদ বলেন, ‘‘নিজে বিশেষ পড়াশোনা জানি না। বাড়িতে ফোনও নেই। মেয়ে কখনও গৃহশিক্ষক, কখনও পাড়ার দাদা-দিদিদের সাহায্যে উত্তর লিখছে।’’
পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে পুকুরকাটা গ্রামের বাসিন্দা, নবম শ্রেণির ছাত্রী শকুন্তলা সরেন এবং তার দাদা, দশম শ্রেণির বিকাশের সমস্যাও এক। শকুন্তলা বলে, ‘‘অন্য বিষয়গুলি বই পড়ে বুঝলেও ইংরেজি আর অঙ্কে অসুবিধা হচ্ছে।’’ বেলপাহাড়ির বাসিন্দা, ছাত্রী মণিকা সিংহও বলছে, ‘‘বাবা-মা বেশি দূর পড়াশোনা করেননি। তাই প্রশ্নের উত্তর লিখতে সমস্যা হচ্ছে। স্মার্ট ফোন না থাকায় স্কুলের হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে আলোচনারও সুযোগ নেই।’’
পাঁশকুড়ার শ্যামসুন্দরপুর পাটনা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গৌতমকুমার বসু মেনে নিচ্ছেন, ‘‘যে সব ছাত্রছাত্রী শুধুমাত্র স্কুলের উপর নির্ভরশীল, তারা খুবই সমস্যায় পড়েছে।’’ শুধু এমন পড়ুয়াই নয়, বস্তুত সকলকে সাহায্য করতেই শিক্ষকরা মাথা খাটিয়ে পড়ানোর নানা পদ্ধতি বার করেছেন। কোথাও মাইকে পড়া বাজানো হচ্ছে। বালুরঘাটের ৩০ জন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক দূরের গ্রামে খুদে পড়ুয়াদের হাতে সরাসরি বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র পৌঁছে দিচ্ছেন। বর্ধমানের নতুনগ্রাম প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা গ্রামে গিয়ে কয়েক জন ছাত্র জড়ো করে পড়াতে শুরু করেছেন। হাওড়া শ্যামপুরের খাজনাবাহালা হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মনিরুল ইসলাম জানান, তাঁরা অভিভাবকদের নিয়ে তিন দিনের শিবির করে কী ভাবে বাচ্চাদের ‘স্টাডি মেটেরিয়াল’ দিয়ে পড়াতে হবে, তা হাতেকলমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মনিরুল বলেন, ‘‘আরও বলা আছে, প্রয়োজনে যেন ছাত্র বা অভিভাবক আমাদের ফোন করেন।’’
শিক্ষকদের এই চেষ্টায় কিছু পড়ুয়ার কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সকলের কাছে এখনও পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। যদিও চেষ্টা অব্যাহত। টিভি, বাংলার শিক্ষা পোর্টাল বা শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে গিয়ে পড়ানোর চেষ্টাও হয়েছে। রাজ্যের সরকারি স্কুল শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে ইউটিউবে একটি লাইভ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। অনুষ্ঠানে নবম, দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয়। সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু জানান, সব ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। আমপান ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজ্য সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার অবশ্য মনে করেন, ছবিটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়। তাঁর কথায়, এখন শুরু হচ্ছে রেডিয়োর মাধ্যমে পড়াশোনা। এর মধ্যে মিড ডে মিলের সঙ্গেই দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নপত্র। প্রশ্ন থাকলে টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করে শিক্ষকদের সঙ্গে কথাও বলতে পারবে পড়ুয়ারা। অভীক বলেন, ‘‘করোনা সংক্রমণের কথা তো কেউ আগে জানত না। কেউ তৈরিও ছিল না। তার মধ্যেও রাজ্য চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে পড়ুয়াদের লেখাপড়া চালু থাকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy