বই ছেড়ে মাথায় মাটির ঝুড়ি তুলতে হয়েছে মৌসুনি দ্বীপের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শেখ সোহেলকে। ছবি:দিলীপ নস্কর।
হিঙ্গলগঞ্জের কুলেরমাঠ গ্রামের সীমা মণ্ডল ত্রাণ শিবির থেকে বাড়ি ফিরেছে। স্থানীয় রানিবালা গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীটির বাড়ি অবশ্য এখনও মেরামত হয়নি। স্কুলে ক্লাস হচ্ছে স্মার্টফোনে। সীমার স্মার্টফোন নেই।
নামখানার মৌসুনি দ্বীপের বালিয়াড়া হাইস্কুলের ছাত্র শেখ সোহেল আগামী বছর মাধ্যমিক দেবে। আমপানে জমি-জিরেত গিয়েছে। তার স্কুলেও চলছে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’। খোঁজ রাখে না সোহেল। সে বাবার সঙ্গে ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজে ব্যস্ত।
হিঙ্গলগঞ্জের বাইনারা গ্রামের ব্রততী বিশ্বাসও মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আমপানের পর থেকে তার ঠিকানা ছিল নদীবাঁধ। তিন দিন আগে বাড়ি ফিরেছে। অনলাইন ক্লাস করবে কী, কেরোসিনের কুপি জ্বেলে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ কোথায়!
লকডাউন এবং আমপান— জোড়া ধাক্কায় রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকায়, বিশেষ করে সুন্দরবনের স্কুল-পড়ুয়ারা যেন এক ‘নেই-রাজ্যের’ বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে!
আয়লার পরে সুন্দরবনের বহু এলাকায় স্কুলছুট বেড়েছিল। পেটের দায়ে কাজ জোটাতে হয়েছিল তাদের। এ বার করোনার ধাক্কা কাটিয়ে স্কুল যদি বা ভবিষ্যতে খোলেও, ক্লাসঘরে কত পড়ুয়া ফিরবে, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের কথা থেকেই। কারণ, আমপানের আগে বিভিন্ন স্কুলের হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে যে সব ছাত্রছাত্রী ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ করছিল, তাদেরও অনেকেই সরে গিয়েছে।
হিঙ্গলগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, অল্প কিছু পড়ুয়াকে নিয়ে চলছিল তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। আমপানের পর আর পড়ুয়াদের কোনও সাড়া নেই। পরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, ঝড়ে প্রভূত ক্ষতি হয়েছে অনেক পরিবারের। পড়ুয়ারা পড়াও বন্ধ।
লককডাউনের বয়স যখন প্রায় এক মাস, নবম-দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ক্লাস করানোর সিদ্ধান্ত নেয় জয়নগরের একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। ক্লাসপিছু ৩০-৪০% পড়ুয়ার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর মিলেছিল।
আমপানের পরে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ শুরু হয়ে দেখা গেল, পড়ুয়ারা গ্রুপ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ কথা জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষই। কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, কারও বাড়ি ভেঙেছে, কারওর ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
হিঙ্গলগঞ্জের ঘোষপাড়ার নবম শ্রেণির চামেলি দালাল, ছন্দা বিশ্বাস, সপ্তম শ্রেণির শিবানী মণ্ডলদের কথা শোনা যাক। তারা বলছে, “আমপানে নদীবাঁধ ভেঙে বাড়ি জলে ডুবল। অনেক দিন ত্রাণ শিবিরে ছিলাম। আগে সহপাঠীদের ফোন থেকে দেখে নিতাম। তাদের কারও কারও ফোন জলে ভেসে গিয়েছে। ক্লাস শুরু হয়েছে কি না তাও জানি না।”
হিঙ্গলগঞ্জেরই রানিবালা গার্লস হাইস্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ ক্লাসে যুক্ত হতে পেরেছে ৫০ শতাংশেরও কম পড়ুয়া। শিক্ষকেরা বলছেন, ‘‘এর বড় কারণ বেশির ভাগ অভিভাবকের স্মার্টফোন কেনার ক্ষমতা নেই।’’
তাই সন্দেশখালির রাধারানি হাইস্কুল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পঠনপাঠন চালু করলেও এখন তা কার্যত বন্ধ বলে জানালেন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক। মথুরাপুর-২ ব্লকের সুন্দরবন সন্তোষ ঘড়ুই বালিকা বিদ্যালয়ের ৪২ জন পড়ুয়া আগামী বছর মাধ্যমিকে বসবে। প্রধান শিক্ষিকা মাধবী মণ্ডল জানান, ৯০% ছাত্রীর পরিবারে স্মার্টফোন নেই। ফলে, কোনও ক্লাস করাচ্ছেন না তাঁরা। মিড-ডে মিল বিলির দিনে অভিভাবকদের বিভিন্ন বিষয়ের মডেল প্রশ্নপ্রত্র দেওয়া হচ্ছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, এখানকার ৬০% ছাত্রছাত্রী অনলাইনে ক্লাস করতে পারলেও বাকিরা তা থেকে বঞ্চিত। আমপানে এই জেলায় সর্বাধিক ক্ষতি হয় নন্দীগ্রাম-খেজুরিতে। খেজুরি-২ ব্লকের বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলের একাধিক পড়ুয়া জানাল, ঝড়ের পর স্কুলের পড়াশোনাই হচ্ছে না। একই অভিজ্ঞতা কাঁথি-১ ব্লকের মাজিলাপুর হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রেরও।
সমস্যা যে সহজে মিটবে না তা-ও মানছেন বিভিন্ন স্কুলের কর্তৃপক্ষ। মিনাখাঁর চৈতল পল্লিমঙ্গল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, “আগামী দিনে মেধাবী পড়ুয়াদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিবির করে পড়ানোর কথা ভাবছি।”
এমন কিছু পথ ধরেছেন অনেক শিক্ষকই। তাতে সার্বিক সমস্যা কি মিটবে? সাগরদ্বীপের দশম শ্রেণির যে ছাত্রীটি কোনও ক্লাস ফাঁকি দেয় না, একটি স্মার্টফোনের অভাবে নতুন ক্লাসের সিলেবাস শেষই করতে পারবে না সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy