Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Shahjahan Sheikh Arrest

‘লোকদেখানো খাঁচায় বাঘের যত্ন হবে না তো?’

পুরুষেরা কথা না শুনলেই ঘরে ঘরে মহিলাদের সাদা থান পৌঁছে দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল সন্দেশখালিতে। সেই আতঙ্কের জবাব দিতে চায় সমস্ত এলাকা।

Shahjahan Sheikh

শেখ শাহজাহানকে বসিরহাট আদালতে পেশ করা হচ্ছে। ছবি: নির্মল বসু।

সোমা মুখোপাধ্যায়
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩৫
Share: Save:

অবিশ্বাস। সন্দেহ। আশঙ্কা।

যে শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারির দিকে ৫৫ দিন ধরে তাকিয়ে ছিল গোটা রাজ্য, গত ২৩ দিন ধরে যেখানকার মহিলারা একটানা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছেন, বৃহস্পতিবার সেখানকার আবহে আনন্দ-উৎসবের চেয়ে বেশি গাঢ় ছিল অবিশ্বাসের রং। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে প্রায় একই দৃশ্য। ঘরের বাইরে জটলা করছেন তাঁরা। প্রশ্ন করলে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও ফুটছে, কোথাও আবির খেলার আয়োজন হলে সেখানে দু’দণ্ড দাঁড়াচ্ছেন। পরস্পরকে মিষ্টিও খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরক্ষণেই তাঁদের কপালে ভাঁজ। “সামনের দিনগুলোতে কী হয় দেখি...” বিড়বিড় করেছেন অনেকে।

শিবপ্রসাদ হাজরা, উত্তম সর্দার, শেখ শাহজাহান— ৩ জনই তো গরাদের ভেতরে। তা হলে এখনও দুশ্চিন্তা? “বাঘ খাঁচায়। কিন্তু যে বাঘকে খাঁচায় ভরতে রাজ্য সরকারের পুলিশ এতটা সময় নিল, তারা যে লোকদেখানো খাঁচায় ভরে তার ভেতরেই বাঘের যত্নআত্তির ব্যবস্থা করবে না তার নিশ্চয়তা কী! বাঘের সাঙ্গোপাঙ্গরা কিন্তু অনেকেই বাইরে। এর পর আমাদের ওপর কী নেমে আসবে জানি না।” ৮ নম্বর কর্ণখালির সোমা দাস যখন কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর পাশে দাঁড়ানো বাকি মহিলাদের গলাতেও তখন একই সুর।

প্রভাতী মণ্ডল বললেন, “অন্ধকারের দিন শেষ, সেটা ভাবতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভাবতে পারছি না, কারণ, পুলিশ-প্রশাসন কাউকেই আমরা আর বিশ্বাস করি না। আদালতে যে ভঙ্গিতে শাহজাহান আজ হেঁটে যাচ্ছিল, সেটা কোনও অভিযুক্তের হাঁটার ভঙ্গি বলে মনে হয়েছে? মিডিয়ার ভিড় হালকা হলে আমাদের উপর কী নেমে আসবে জানি না।”

খুঁজতে খুঁজতে কলোনি পাড়া, পাত্র পাড়া হয়ে পৌঁছলাম আর এক জায়গায়। যাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে শিবপ্রসাদ গ্রেফতার হয়েছিল, নির্যাতিত সেই প্রথম অভিযোগকারিণীকে সকাল থেকে দেখেননি অনেকেই। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে শেষ পর্যন্ত যখন তাঁর সামনে পৌঁছনো গেল, তিনি তখন মোবাইলে কথা বলছিলেন। “দাবার ঘুঁটি হয়ে গেলাম না তো!”—তীব্র বিতৃষ্ণা ঝরছিল তাঁর গলায়। কথা বলার জন্য এগোতেই হাত তুলে নিষেধ করলেন। “আমি কথা বলতে চাই না। আমার বাচ্চাটার কিছু হলে তার দায়িত্ব কে নেবে? রাতে হামলার ভয়ে নিজের বাড়িতে থাকতে পারি না। পালিয়ে বেড়াতে হয়। আন্দোলন করতে এসে নিজের পাওনাগণ্ডা বুঝে কেউ কেউ এখন সরে গিয়েছেন। কিন্তু আমি তো সরতে পারব না! আমার জন্য আরও বড় কোনও অন্ধকার অপেক্ষা করছে কী নাকে জানে!’’

বস্তুত সন্দেশখালি জুড়ে এখন এই ভয়েরও আনাগোনা। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়েও ইতিমধ্যে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে মহিলাদের একাংশের মধ্যে। কিন্তু তারই পাশাপাশি চলছে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা। পাত্র পাড়ার রেবতী মণ্ডল কাঁদছিলেন। পাশে দাঁড়ানো দুই কিশোরী কন্যাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ভয়ে ওদের বাড়িতে রাখতে পারতাম না। অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল। কখন ওদের উপরেও নোংরা নজর পড়বে তা তো জানতাম না।’’ ফোঁপাতে থাকেন তিনি। দুই মেয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। রেবতী বলতে থাকেন, ‘‘আমার স্বামী ওদের কথা শোনেনি বলে একদিন ওকে বেধড়ক মারতে মারতে বাড়ি থেকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওদের হাতেপায়ে ধরে আটকাতে গেলাম। আমাকে এমন ধাক্কা মারল ছিটকে পড়লাম। আমার হাত ভেঙে গেল! এখনও সেই হাত অকেজো। এই অত্যাচার, এই অসম্মান ভুলব না, কাউকে ভুলতেও দেব না।’’

কিছুই ভোলেনি সন্দেশখালি। বেড়মজুরের কাকলি দাস বললেন, ‘‘সব অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। সব অপমানে প্রলেপ-ও পড়ে না। আন্দোলন চলবে। যদি কেউ ভয় পায়, অন্যরা তার হাত ধরবে।’’

ত্রিমনি বাজারে শিবপ্রসাদের নিজস্ব অফিসে, যেখানে রাতের পর রাত মেয়েদের ডেকে আনা হত, বসিয়ে রাখা হত, অত্যাচার চালানো হত বলে অভিযোগ, তালা বন্ধ সেই অফিসের আশপাশ এ দিন খাঁ খাঁ করছে, যদিও সপ্তাহ তিনেক আগের ভাঙচুরের সমস্ত চিহ্ন এখনও চারপাশে ছড়িয়ে। এমনকি ভাঙা কাচগুলোও সরানো হয়নি। প্রতিবাদের সেই সাক্ষ্য এখনই মুছে যাক তা চান না সন্দেশখালির মহিলারা।

৮ নম্বর কর্ণখালিতে শিবপ্রাসাদের আলাঘরে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। মাছের ভেড়ির জল বার করে দেওয়া হয়েছিল। তবে কিছু জায়গায় এখনও জল জমে আছে। সেখানে স্থানীয়রা এ দিন মাছ ধরছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা বললেন, ‘‘এটা আমাদের জমি। আমাদেরই অধিকার। সব অধিকার ফেরত চাই আমরা।’’

পুরুষেরা কথা না শুনলেই ঘরে ঘরে মহিলাদের সাদা থান পৌঁছে দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল সন্দেশখালিতে। সেই আতঙ্কের জবাব দিতে চায় সমস্ত এলাকা। উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে তাই সতর্ক থাকা, পরিস্থিতির দিকে নজর রাখাই এখন তাঁদের দায়িত্ব বলে মনে করছে সন্দেশখালির প্রমীলা বাহিনী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy