Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Health System

‘মেয়ে রোজ বাড়ি ফিরবে, চান তো?’ প্রতিবাদ করলেই শাস্তি, স্বাস্থ্যে দুর্নীতি-রাজ

টোকাটুকি বন্ধে সামান্য উদ্যোগী হতেই এক মেডিক্যাল কলেজের ডিনকে শুনতে হয়েছিল, ‘স্যর, আপনি তো একা থাকেন। রাতবিরেতে কিছু হয়ে গেলে কে বাঁচাবে বলুন তো!’ ‘স্যর’ আর ‘ঝামেলা’ বাড়াননি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৬:৪৫
Share: Save:

ফোনের ওপারে এক চিকিৎসক। ঠান্ডা গলায় বলছেন, ‘মেয়ে রাতে কোন রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরে? রোজ ফিরবে, সেটা চান তো?’ আর কথাগুলো যাঁকে বলা হচ্ছে, তিনি দক্ষিণবঙ্গের একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা এই কাজ বরদাস্ত করবেন না। সেই ‘অপরাধে’ই তাঁকে শুনতে হয় সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে ওই হুমকি।

অভিযোগ, স্বাস্থ্য ভবনে শীর্ষ কর্তাদের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলেন অধ্যক্ষ আর কর্তার জবাব ছিল, ‘কোনও প্রমাণ তো নেই। তা হলে আর কী করতে পারি বলুন?’ ‘টোকাটুকিটা তো অন্তত আটকানোর চেষ্টা করবেন স্যর?’ অধ্যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে শীর্ষ কর্তা বলেছিলেন, ‘আপনি ফিরে যান। যা করার করব।’

কী করেছিলেন তিনি? অধ্যক্ষ হেসে উত্তর দেন, ‘‘প্রশ্ন ফাঁস এবং টোকাটুকি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ছিল!’’

টোকাটুকি বন্ধে সামান্য উদ্যোগী হতেই এক মেডিক্যাল কলেজের ডিনকে শুনতে হয়েছিল, ‘স্যর, আপনি তো একা থাকেন। রাতবিরেতে কিছু হয়ে গেলে কে বাঁচাবে বলুন তো!’ ‘স্যর’ আর ‘ঝামেলা’ বাড়াননি। কারণ, তিনিও বিলক্ষণ জানেন, চুপচাপ সব দেখে যাওয়ার জন্য অনেকেই আছেন, কিন্তু বাঁচানোর জন্য কেউ নেই।

কী মনে হচ্ছে? ওটিটি প্ল্যাটফর্মের হাড়হিম করা সিরিজ়-এর গল্প? না, সিরিজ় এখনও তৈরি হয়নি বটে, কিন্তু হয়ে যাবে যে কোনও দিন, এতটাই ভরপুর রসদ এ রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

অথচ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমনই নিরাপত্তা মেনে কলেজগুলিতে পৌঁছয় যে আপাত ভাবে কেউ ভাবতেই পারবেন না নেপথ্যে কী চলছে। পরীক্ষা শুরুর ৪৫ মিনিট আগে অধ্যক্ষের কাছে ‘কোড’ আসে। সেই ‘কোড’ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সাইটে গিয়ে আর একটি ‘কোড’ ব্যবহার করে ই-মেলে প্রশ্ন ঢোকে। সিসি ক্যামেরার নজরদারির মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই প্রশ্নের প্রিন্ট নিয়ে তার পরে পড়ুয়া সংখ্যা অনুযায়ী তা ফটোকপি করা হয়। খামবন্দি হয়ে সেই প্রশ্ন পৌঁছয় পরীক্ষার ঘরে।

গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে কার্যত দুর্নীতির দর্শক হয়ে থাকা অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-চিকিৎসকদের বড় অংশ অভিযোগ করেছেন, গত কয়েক বছর এই নিয়মের বাইরেই চালু হয়েছে আর এক নিয়ম। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পৌঁছে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের একটা অংশের কাছে। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে অধ্যক্ষদের দিকে নিশানা করলেও তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি— প্রশ্ন বেরোয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। দু’দিন আগে বেরোলে তার এক রকম রেট, এক দিন আগে হলে আর একটু কম। আর যদি পরীক্ষার সামান্য সময় আগে তা হয়, তা হলে রেট আরও খানিকটা কমে।

এই নয়া ‘পরীক্ষা ব্যবস্থা’-য় এক সঙ্গে একাধিক মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়াদের উত্তরপত্র দাঁড়ি-কমা সমেত হুবহু এক, এমনও হয়েছে বার বার। এক শিক্ষক-চিকিৎসকের অভিযোগ, ‘‘কিছু পড়ুয়া পরীক্ষা শুরুর আধ ঘণ্টা-৪৫ মিনিট পর ঢোকে। কারণ, তারা কম রেটে পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্ন কিনেছে। হল-এ ঢুকেই তারা উত্তরপত্রের ফটোকপি থেকে মন দিয়ে টুকতে শুরু করে। সামনে যদি গিয়ে দাঁড়াই, ঠান্ডা চোখে পাল্টা তাকিয়ে থাকে। আমরাই মাথা নিচু করে চলে আসি।’’

কেউ প্রতিবাদ করেন না? ‘‘করলে কী হয়, সেটা তো সবাই জানে। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, প্রতিবাদ করে ফল কী হবে? স্বাস্থ্য ভবন থেকেই তো আমাদের বলা হয়, এ সব নিয়ে মাথা না ঘামাতে,’’ অভিযোগ উত্তরবঙ্গের এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের। বললেন, ‘‘স্বাস্থ্য ভবনে শীর্ষ কর্তার অনুমতি নিয়ে এক বার টোকাটুকি বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন এই কলেজে আমার এক সহকর্মী। সেই কর্তা আবার দাবি করেছিলেন, তিনি নাকি নবান্ন থেকেও সবুজ সঙ্কেত এনেছেন। ভরসা করে ঝাঁপ দেওয়া হয়েছিল।’’ তার পর? ‘‘২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওই সহকর্মীর বদলির অর্ডার আসে।’’

‘বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, অভীক দে অ্যান্ড কোম্পানি’ সন্দীপ ঘোষের তত্ত্বাবধানে যা যা করে এসেছে বলে অভিযোগ, দিনের পর দিন তাতে সিলমোহর দিয়েছেন স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা, এমনই অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক-চিকিৎসকদের একটা অংশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে কী বলছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তারা? স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম বলেন, ‘‘পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয় পুরোটাই স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়। এ বিষয়টা তারাই বলতে পারবে।’’ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক বলেন, ‘‘আমি বেশি দিন আসিনি। এখনও ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। এর মধ্যেই একটা পরীক্ষায় কিছু অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েছিলাম।"

স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সুহৃতা পালের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনেছেন অধ্যক্ষেরা। সুহৃতা বলেন, ‘‘আমি এ সব কথা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম। কলেজ ধরে ধরে সেন্টার ইন-চার্জদের কাছে বার বার জানতে চেয়েছি, কী হয়েছে। কেউ কোনও অভিযোগ করেননি। আমি তো গত ১৩ মাস ওখানে নেই। তা হলে ওই সময়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সেই সময় নিয়েও অভিযোগ উঠছে কেন?’’ ‘কন্ট্রোলার অব এগ্‌জ়ামিনেশনস’ শ্রাবণী বিশ্বাস বলেন, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জানাতে পারব। একটু সময় লাগবে।’’

প্রশ্ন হল, তা হলে কোন অদৃশ্য ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে বছরের পর বছর এমন হয়েছে? শুধু তো প্রশ্ন ফাঁস নয়। ফেল করা পড়ুয়াকে পাশ করানো, এমনকি অনার্স নম্বর দেওয়ায় জন্যও কর্তৃপক্ষের থেকে চাপ আসে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান প্রণীতা তরফদার বলেন, ‘‘যারা অনার্স পাওয়ার যোগ্যই নয়, তাদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষ তো বটেই, স্বাস্থ্য ভবন থেকেও চাপ এসেছে। নির্দিষ্ট কয়েক জনের মৌরসিপাট্টা চলে। প্রতিবাদ করায় আমাকে হেনস্থা করা হয়েছে।’’

সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান বলেন, ‘‘আমি বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে যখন ছিলাম, তখন এই দৌরাত্ম্য সে ভাবে সামলাতে হয়নি। এখানে আসার পরে সহকর্মীদের কাছে যা শুনছি, তা তো ভয়ঙ্কর।’’

ক্লাস করার দরকার নেই, রোগীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে শেখারও কিছু নেই। টাকা ফেলো, প্রশ্ন কেনো। এখন তো আবার প্রশ্ন বুঝে নেওয়ার ঝক্কিও থাকে না সব সময়ে। প্রশ্নপত্রের নম্বর মিলিয়ে উত্তরপত্র হাতে চলে আসে। শৌচাগারে বিলি হয় সেই উত্তরপত্র। পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে সোজা টুকে দেওয়ার পালা। সিসি ক্যামেরার মুখ কখনও অন্য দিকে ঘোরানো থাকে, কখনও ক্যামেরার সামনেই অবাধে চলে এই কাজ। কারণ, সবাই জানে ওই সব ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করাই হবে না কোনও দিন। আর প্রয়োজন হলে না হয় নির্দিষ্ট অংশ ‘এডিট’ করে দেওয়া যাবে। প্রযুক্তির উন্নতির যুগে চ্যাট জিপিটি-র সাহায্য নিয়েও চলে লেখালেখি। মোবাইল নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে অবাধে ঢুকে যাঁরা এই কাজগুলো করেন, তাঁদের হাতেই সাধারণ মানুষের জীবন নির্ভর করবে আর কয়েক বছর পরে। সকলে নন অবশ্যই। কিন্তু পড়ুয়াদের বড় অংশ এই চক্রের শিকার বলে জানা গিয়েছে।‘দাদা’দের হাত ধরে নিজেদের এমন ভবিষ্যৎ তৈরি করে কী শিখছেন তাঁরা? এক শিক্ষক-চিকিৎসক বললেন, ‘‘অনার্স পাওয়া পড়ুয়া কিডনির সমস্যাকে বলছে থ্যালাসেমিয়া। পাকস্থলীকে চিহ্নিত করছে মূত্রথলি হিসেবে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গই চিনতে শেখেনি অনেকে, চিকিৎসা তো দূরের কথা।’’

শিক্ষিক-চিকিৎসক তথা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখার সহ-সম্পাদক অনির্বাণ দলুই বলেন, ‘‘আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখনও টোকাটুকি ছিল। কিন্তু যারা করত, তারা লুকিয়ে করত। এখন প্রতিনিয়ত দেখে চলেছি, এটাই নিয়ম। যারা পড়াশোনা করে, করতে চায়, তাদেরও ভয় দেখিয়ে নীতি-নৈতিকতার বোধ চুরমার করে দিয়ে এই অপরাধে শামিল করা হচ্ছে।’’

অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এমবিবিএসে প্রায় কিছুই না শেখা আর পোস্ট গ্রাজুয়েশনেও জোড়াতালি দিয়ে চলা... ভয় হয়, ভবিষ্যতে কারা করবে আমাদের চিকিৎসা?’’

কিন্তু এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করাল কে? যে ছেলেমেয়েরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে ডাক্তার হতে আসছেন, তাঁদের শুরুতেই এমন বিষাক্ত পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করাল কারা? প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তার হবেন, এমন ভেবে নিশ্চয় তাঁরা দিনরাত এক করে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেননি?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy