হিরাপুর থানার এই এলাকায় রয়েছে ‘অবৈধ’ কুয়ো খাদান। ছবি: পাপন চৌধুরী
‘এখানেও!’— বেশ কিছু দিন বাদে বিশেষ ট্রেনে করে দিল্লি থেকে সম্প্রতি পশ্চিম বর্ধমানের হিরাপুরে ফিরেছেন পেশায় বেসরকারি সংস্থার কর্মী অর্পণ গোস্বামী। শিল্পাঞ্চলের ছেলে হওয়ায় অবৈধ কুয়ো খাদান কেমন দেখতে হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে তাঁর। কিন্তু বিস্ময়ের কারণ, হিরাপুরের ওই এলাকায় এমন কুয়ো খাদান আগে দেখেননি তিনি।
‘‘অবাক হওয়ার কী আছে?’’, বলছেন পশ্চিম বর্ধমান শিল্পাঞ্চলের এক পরিচিত অবৈধ কয়লার কারবারি। তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই জানান, এপ্রিল-মে এই দু’মাস ‘লকডাউন’-এর জন্য কারবার বন্ধ ছিল। ফলে, ওই দু’মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন-নতুন জায়গায় ভূগর্ভে হাত দিতে হচ্ছে তাঁদের।
সিপিএম নেতা বংশগোপাল চৌধুরী, বিজেপির জেলা সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোড়ুইদের দাবি, ‘আনলক’-পর্বে হিরাপুরের সূর্যনগর, ঢাকেশ্বরী, রানিগঞ্জের বাঁশড়া, অমৃতনগর লাগোয়া নারায়ণকুড়ি, বারাবনির গৌরাণ্ডি, ভানোড়া-সহ বেশ কিছু এলাকায় নতুন কুয়ো খাদান দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি, ইসিএল-এর বৈধ কিছু খোলামুখ খনি, পরিত্যক্ত খোলামুখ খনির দেওয়ালে গর্ত খুঁড়ে (‘র্যাট হোল’) কয়লা সংগ্রহও শুরু হয়েছে বলে জানান কারবারিরাই।
কী ভাবে নতুন খাদানের জায়গা বাছা হয়?
কারবারে জড়িতদের দাবি, খনিতে কাজ করা প্রাক্তন (কখনও বর্তমান) কর্মীদের সূত্রে কোন এলাকায় কয়লার স্তর রয়েছে, সে খোঁজ নেন ‘মাথা’রা। কখনও পারস্পরিক সম্পর্কে খবর আসে, কখনও টাকা দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট জায়গায় যন্ত্র দিয়ে একটা পাইপ ঢোকার মতো ‘বোর হোল’ করা হয়। যদি ভূপৃষ্ঠের থেকে ৪০ ফুটের মধ্যে কয়লা মেলে তা হলে খোলা মুখ খনি করা হয়। কয়লার স্তর তার চেয়ে গভীরে থাকলে, কুয়ো খাদান। যদি জমিটি ব্যক্তি মালিকানার হয়, তা হলে কখনও তা কেনা হয়, কখনও জমির মালিক টাকার বদলে প্রতি টন তোলা কয়লার শতাংশ নেওয়ার চুক্তি করেন। আবার কখনও জবরদখল করা হয়। তার পরে শুরু অবৈধ খাদানের কাজ।
অবৈধ কয়লার ভাল ‘চাহিদা’ রয়েছে জেলা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, কলকাতা-সহ রাজ্যের নানা প্রান্ত এবং বারাণসী, লখনউ-সহ উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন ইটভাটা, বেসরকারি ইস্পাত কারখানা, স্পঞ্জ আয়রন, ফেরো-অ্যালয়, গুল কারখানায়। মূলত সেই সব শিল্পক্ষেত্রে যেখানে বয়লার বা ফার্নেস আছে। এর প্রধান কারণ, ‘ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড’ বা ইসিএল-এর কয়লার জোগান নিয়ন্ত্রিত। ফলে, নির্ধারিত ‘কোটা’র বাইরে কয়লা কিনতে হলে খোলা বাজারের অবৈধ কয়লা কাজে লাগে ছোট শিল্পোদ্যোগীদের একাংশের। সাধারণ ভাবে, গুণমান অনুযায়ী, ইসিএলের কয়লার দর টন প্রতি তিন-চার হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ‘অবৈধ’ কয়লার দর এর থেকে অনেক কম। ট্রাক বা ডাম্পারে করে (এক-একটিতে ২৬-৪০ টন) বিভিন্ন কারখানায় পাচার হয় সাধারণত, জানাচ্ছে পুলিশের একটি সূত্র।
এই চাহিদার দিকে তাকিয়ে এবং ‘লকডাউন’-এর দু’মাসের ক্ষতি পোষাতে কয়লা তোলায় এবং মজুত করায় জোর দেওয়া হয়েছে, জানাচ্ছেন কারবারিরা। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি কুয়ো খাদান থেকে সাধারণ ভাবে ১৮ হাজার টাকা প্রতি দিন লাভ থাকে। এখন তা ১০ হাজার টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করছে।
বাজার ‘চড়া’ না হলেও কেন কয়লা তোলা হচ্ছে? কারবারিদের ব্যাখ্যা, এখনও তাঁদের ক্রেতাদের কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু ‘বাজার ঘুরবে’, এই আশা নিয়েই কয়লা মজুত করা হচ্ছে।
তোলা কয়লা অবৈধ খাদান থেকে দূরে পাঠাতে ভরসা ট্রাক ও ডাম্পার। কাছাকাছির মধ্যে ট্রাক্টর, গরুর গাড়ি, সাইকেল, মোটরবাইকে করেও কয়লা পাচার হয়। কিন্তু একাধিক জেলা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয় কী ভাবে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ট্রাক-ডাম্পার চালক জানান, তাঁদের কাছে নির্দিষ্ট সঙ্কেত-চিহ্ন আঁকা কাগজ থাকে (‘প্যাড’)। ‘কয়লা-সিন্ডিকেট’-এর তরফে মেলা ওই ‘প্যাড’ কার্যত অবৈধ কয়লার ‘চালান’। তাঁদের দাবি, ‘‘প্যাড থাকলে কেউ গাড়ি আটকাবে না।’’
এই কয়লা উত্তোলন এবং সরবরাহ কী ভাবে চলে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। রানিগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক রুনু দত্ত, বিজেপির জেলা সভাপতি লক্ষ্মণবাবুর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল ও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের মদতেই এই কারবার চলছে।’’ যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি জিতেন্দ্র তিওয়ারির দাবি, ‘‘দলের কেউ কোনও অবৈধ কারবারের সঙ্গে জড়িত নন। ইসিএল চাইলেই সব বন্ধ করতে পারে।’’
ইসিএল-এর সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় বলেন, ‘‘সিআইএসএফ ‘খনন প্রহরী’ অ্যাপের মাধ্যমে অবৈধ কারবারের খবর পেলেই অভিযান চালায়। প্রতি বছর বিভিন্ন থানায় অবৈধ খাদান সংক্রান্ত প্রায় হাজারখানেক অভিযোগ জমা করা হয়।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের কর্তাদের একাংশের দাবি, পাচারের খবর পেলেই অভিযান চালানো হয়। তবে দীর্ঘদিন তেমন কোনও খবর তাঁরা পাননি, এই যা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy