Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Chopra Assault Case

খুন, অপহরণ-সহ একাধিক অপরাধেই জড়িত চোপড়ার জেসিবি! ‘বিধায়ক-ঘনিষ্ঠ’ বলেই কি বার বার রেহাই?

পুলিশ সূত্রে খবর, চোপড়ার যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেই লক্ষ্মীপুরে দীর্ঘ দিন ধরে জেসিবির দাপট। তাঁর উত্থান শুরু হয়েছিল ২০১৭ সাল থেকে। তার পর থেকেই একাধিক অভিযোগ উঠেছে জেসিবির বিরুদ্ধে।

বাঁ দিকে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় তাজিমুল হক, সোমবার ইসলামপুরে। ডান দিকে, ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিয়োর মারের দৃশ্য। — নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিকে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় তাজিমুল হক, সোমবার ইসলামপুরে। ডান দিকে, ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিয়োর মারের দৃশ্য। — নিজস্ব চিত্র।

প্রদীপ্তা ঠাকুর
চোপড়া (উত্তর দিনাজপুর) শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪ ২১:২৭
Share: Save:

চোপড়ার তৃণমূল নেতা তাজিমুল হক ওরফে জেসিবির বিরুদ্ধে অতীতেও পুলিশে বহু অভিযোগ দায়ের হয়েছে। খুন, খুনের চেষ্টা, অপহরণের মতো অভিযোগের মামলায় জড়িয়েছে তাঁর নাম। যুগলকে প্রকাশ্যে নিগ্রহের অভিযোগ নিয়ে রাজ্য জুড়ে শোরগোলের আবহে সেই সব পুরনো মামলার প্রসঙ্গই উঠে আসতে শুরু করেছে।

রবিবার দুপুরেই তৃণমূলের চোপড়ার নেতা জেসিবির একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে। ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। সেই ভিডিয়োয় দেখা যায়, এক তরুণীকে রাস্তার মধ্যে ফেলে এক ছড়া কঞ্চি দিয়ে বেধড়ক মারছেন জেসিবি। মার খেতে খেতে গুটিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলা হচ্ছে। তার পরে আবার শুরু হচ্ছে মার। এক তরুণকেও একই ভাবে মারতে দেখা যায় তাঁকে। সেই ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পরেই শোরগোল পড়ে যায়। শাসকদলকে নিশানা করতে শুরু করে বিরোধীরা। এর পর ররিবার রাতেই গ্রেফতার হন জেসিবি। সোমবার তাঁর পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে ইসলামপুর মহকুমা আদালত।

পুলিশ সূত্রে খবর, চোপড়ার যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেই লক্ষ্মীপুরে দীর্ঘ দিন ধরে জেসিবির দাপট। তাঁর উত্থান শুরু হয়েছিল ২০১৭ সাল থেকে। তার পর থেকেই জেসিবির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, মারধর, খুন ও অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রুস্তম আলি নামে চোপড়ার এক বাসিন্দা জেসিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন থানায়। গোলাম মুস্তাফা ও আবুল নামে দু’জনের উপর অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলার অভিযোগ তুলেছিলেন রুস্তম। সেই এফআইআরে মোট ৩৭ জনের নাম ছিল। এক নম্বরেই ছিল জেসিবির নাম। এর পর ২০১৯ সালে ১১ মার্চ আজিনা খাতুন নামে এক মহিলা চোপড়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ডাঙাপাড়া থেকে লক্ষ্মীপুর বাজারে যাওয়ার সময় তাঁর উপর আক্রমণ চালিয়েছেন তাজিমুল ও তাঁর দলবল। সেখানেও ৩১ জন অভিযুক্তের মধ্যে জেসিবির নাম রয়েছে। ইসলামপুর পুলিশ জেলার সুপার জোবি থমাস আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘উনি তৃণমূলের নেতা কি না তা বলতে পারব না। তবে ক্রিমিনাল। আমরা নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওঁকে গ্রেফতার করেছি। ওঁর নামে আগেও নানাবিধ গুরুতর অভিযোগ হয়েছে।’’

পুলিশ সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, ২০২১ সালে জেসিবির বিরুদ্ধে অপহরণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বর তারিখে সাবুজান নেসা নামে এক মহিলা তাজিমুল ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন চোপড়া থানায়। তাঁর অভিযোগ ছিল, ১ সেপ্টেম্বর তাঁর ছেলে ওসমান গনি ইসলামপুর কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় তাঁকে অপহরণ করা হয়। দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁকে। গুলিও করা হয়। পরে তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চোপড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যু হয়েছিল ওসমান গনির। এর পর ২০২৩ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের শেষ দিনে বাম-কংগ্রেস জোটের মিছিলে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছিল জেসিবির বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় এক সিপিএম নেতার মৃত্যুও হয়েছিল। পুলিশে যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তাতে জেসিবির নাম শুরুতেই ছিল বলে জানা গিয়েছে পুলিশ সূত্রে। গ্রেফতারও হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা। কিন্তু অভিযোগ, কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে ছেড়়ে দেওয়া হয়।

বিরোধীদের অভিযোগ, এত বার পুলিশের খাতায় নাম ওঠা সত্ত্বেও কখনওই জেসিবির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা হয়নি। অভিযোগ পেয়ে বেশ কয়েক বার জেসিবিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হত। বিরোধীদের প্রশ্ন, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের ‘ঘনিষ্ঠ’ হওয়ার কারণেই কি বার বার তাঁকে মুক্তি দিত পুলিশ? স্থানীয় এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘বিধায়কের সঙ্গে থাকত জেসিবি। পুলিশ কিছু করতেই ভয় পেত।’’ চোপড়ার কংগ্রেস সভাপতি মাসিরুদ্দিন বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে রেখেছে জেসিবি। লক্ষ্মীপুর এলাকায় কেউ মাথা তুলে কথা বলতে পারছে না। ও গ্রেফতার হওয়ার পর মানুষ আস্তে আস্তে মুখ খুলছে। এর আগেও ওর অত্যাচারের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে।’’

গোটা ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন হামিদুল। তিনি বলেন, ‘‘যা হয়েছে তা একদমই ঠিক হয়নি। আমি মেনে নিচ্ছি। ওই জায়গায় জাতপাত সংক্রান্ত সমস্যা হলে সালিশি সভা হয়। একে আমি বা আমার দল একদমই সমর্থন করি না। তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনও বলেছেন, ‘‘চোপড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তা তৃণমূল বা আমাদের সরকার কোনও ভাবে সমর্থন করে না। এটা আমরা বার বার বলেছি। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছে। মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্যাতিতদের পুলিশি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আরও যদি কেউ এই ঘটনায় জড়িত থাকেন, তাঁরাও পার পাবেন না। তবে তফাত অন্য জায়গায়। ৩৪ বছরের বাম শাসনে বাংলায় এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনও বাম নেতাকে প্রকাশ্যে এসে নিন্দা করতে শুনিনি বা পুলিশ গ্রেফতার করেছে দেখিনি। দেশে বিজেপি শাসিত বহু রাজ্যেও এই ধরনের ঘটনা হামেশাই ঘটে। কিন্তু তা নিয়ে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করছে বা বিজেপি নেতা বিরোধিতা করছেন, তেমনটা ওই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে দেখা যায় না। এটা একমাত্র বাংলাতেই সম্ভব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই ধরনের ঘটনায় ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি রেখেছেন। শুধু মুখে বলা হয় না, কাজেও করে দেখানো হয়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Chopra Assault Case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE