Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Suvendu Adhikari

বিরোধী দলনেতা কি পদ্মের ‘কেন্দ্রশাসিত’ অঞ্চল? দলে বাড়ছে শুভেন্দুর ‘কর্মপদ্ধতি’ নিয়ে আলোচনা এবং জল্পনা

বিরোধী দলনেতা হিসাবে শুভেন্দু অধিকারীর ভূমিকা নিয়ে কোনও সমালোচনা শোনা যায় না রাজ্য বিজেপিতে। তবে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তিনি পা মিলিয়ে চলেন না বলে জল্পনা বহু দিনের।

Many BJP leader thinks Suvendu Adhikari works for party as an union territory

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল ছবি।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৩
Share: Save:

তাঁর কর্মসূচি আগে থেকে জানতে পারেন না রাজ্য নেতৃত্ব। রাজ্য সভাপতির ডাকা বন্‌ধ তিনিই ঘোষণা করে মাঝপথে শেষ করে দেন। নিজে নিজেই ২১ জুলাইয়ে তৃণমূলের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে বসেন। অবশ্য তিনি প্রকাশ্যে বলেনও যে, তিনি সংগঠনের কেউ নন। বলে দেন, দলের সংখ্যালঘু মোর্চার দরকার নেই। সেই ভাষণেই পাল্টে দেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর স্লোগান। রাজ্য স্তরের বৈঠকে প্রায় নিয়মিত গরহাজির থাকেন। থাকেন, যদি সেই বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতারা থাকেন। থাকেন না রাজ্যের কোর কমিটির বৈঠকেও।

রাজ্য বিজেপির অন্দরে শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে অতএব জল্পনা— তিনি কি ‘কেন্দ্রশাসিত’?

এটা অনস্বীকার্য যে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বাংলায় দলের ‘মুখ’ হিসেবে শুভেন্দুকেই মনে করেন। শুভেন্দু ‘জননেতা’। শুভেন্দুর সভায় ভিড়ও হয়। শুভেন্দু তৃণমূলের সরকারে একাধিক মন্ত্রিত্বও সামলেছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক অধিবিদ্যার উপর আস্থা রাখবেন, তা আশ্চর্যের নয়। সম্ভবত এ-ও আশ্চর্য নয়, যা শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠেরা বলেন। তাঁদের কথায়, ‘‘দাদা ওই রকমই। বাকিদেরই একটু মানিয়ে নেওয়া উচিত।’’ এক শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠের তো এমনও দাবি যে, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিজেপির বাকিদের শুভেন্দুর কোনও সমালোচনা করাই উচিত নয়!

তবু আলোচনা এবং জল্পনা হচ্ছে। যা সমালোচনারই নামান্তর। সপ্তাহখানেক আগেও রাজ্য বিজেপিতে যাঁরা শুভেন্দুর ‘ভক্ত’ ছিলেন, তাঁরাই সেই আলোচনা করছেন। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে শুভেন্দু সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন বলে যাঁরা ‘ধন্য ধন্য’ করেছিলেন তাঁরাও এখন ‘নেতা’ শুভেন্দুর ত্রুটি খুঁজছেন।

কেন্দ্রীয় শীর্ষনেতারা উপস্থিত না থাকলে শুভেন্দু দলের বৈঠকে সাধারণত হাজির থাকেন না বলে অভিজ্ঞেরা জানাচ্ছেন। লোকসভা নির্বাচনের পরে গত ১৫ জুনের কোর কমিটির বৈঠকেও তিনি ছিলেন না। সেই বৈঠকেই চার আসনের উপনির্বাচনের জন্য পছন্দের প্রার্থিতালিকা তৈরি হয়েছিল। সক্রিয় রাজনীতিতে এখন আর না থাকলেও বিজেপির এক অভিজ্ঞের কথায়, ‘‘উনি দলে নতুন, এটা তো আর এখন বলা যাবে না। চার বছর হয়ে গিয়েছে। তাঁর এটা জানা উচিত যে, বিজেপির নিয়ম অনুযায়ী বিরোধী দলনেতা সংগঠনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।’’

তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বিজেপির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৬-তে ‘স্টেট কাউন্সিল’ গঠনের কথা রয়েছে। তার ১ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ওই কমিটির সদস্য হবেন রাজ্য বিধানসভার দলনেতা। আবার অনুচ্ছেদ ১৮ অনুযায়ী তিনি ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’-এরও সদস্য।’’ ওই নেতার মতে, বিজেপি পরিষদীয় দল এবং সংগঠন আলাদা করে চালানোর পক্ষপাতী হলেও বিরোধী দলনেতার আলাদা গুরুত্ব থাকে সাংগঠনিক কাজকর্মে।

রাজ্য বর্ধিত কর্মসমিতির বৈঠকের প্রকাশ্য অংশে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে মোদীর ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগান পাল্টে দিয়েছিলেন শুভেন্দু। কিন্তু বৈঠক চলার মধ্যেই তাঁকে ‘সাফাই’ দিতে হয়। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে বলতে হয়, শুভেন্দুর মত দলের মতামত নয়। বিজেপি সূত্রের খবর, ‘সাফাই’ এবং ‘বিবৃতি’— দুই-ই ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে। তার পর থেকেই বিজেপির অন্দরে শুভেন্দুকে নিয়ে জল্পনা আরও বেড়েছে। তাঁর সঙ্গে রাজ্য সভাপতির ‘সমন্বয়’ আছে কি না, আলোচনা শুরু হয়েছে তা নিয়েও।

কোনও কারণে রাজ্য দল এবং বিরোধী দলনেতার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে তার সমাধান রয়েছে বিজেপির সংবিধানে। অনুচ্ছেদ ২৮ অনুসারে একটি সাত সদস্যের সমন্বয় কমিটি গড়া যায়। বাকি ছয় সদস্যের মধ্যে বিরোধী দলনেতা-সহ তিন বিধায়ক থাকা বাধ্যতামূলক। রাজ্যে এই প্রথম বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় অতীতে এই অনুচ্ছেদ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়নি। তবে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে শুভেন্দুর ‘বনিবনা’ না থাকায় একবার এমন কমিটি তৈরি নিয়ে ভাবনাচিন্তা হয়েছিল। যদিও পরে তা কার্যকর হয়নি।

কিন্তু এখন আলোচনা শুরু হয়েছে আবার। দলের কর্মসমিতির বৈঠকের পরে রীতি অনুযায়ী সাত দিনের মধ্যে সব সাংগঠনিক জেলায় কর্মসমিতির বৈঠক করতে হয়। অর্থাৎ, ১৭ জুলাইয়ের বৈঠকের পর ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে জেলা স্তরের কর্মসমিতির বৈঠক সেরে ফেলার কথা। যা ৪৩টি সাংগঠনিক জেলার এক-তৃতীয়াংশের মতো জায়গায় এখনও হয়নি। সংসদের অধিবেশনের কারণে এই সমস্যা বলে দলের দাবি। প্রতিটি বৈঠকেই রাজ্য স্তরের অন্তত এক জন নেতার থাকার কথা। শুভেন্দু কি কোনও বৈঠকে ছিলেন? এক রাজ্য নেতা বলেন, ‘‘শুভেন্দুদা নিজের কর্মসূচি নিজেই ঠিক করেন। তাই তাঁকে দলের তরফে আলাদা করে কোনও বৈঠকে যেতে বলা হয়নি। নিজের এলাকা পূর্ব মেদিনীপুরের দুই সাংগঠনিক জেলা কাঁথি ও তমলুকের বৈঠকে ছিলেন কি না সেটা জানা নেই।’’

২০২২ সালের অগস্টে বৈদিক ভিলেজে বিজেপির প্রশিক্ষণ শিবিরেও শুভেন্দুর উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেখানে সাংসদ, বিধায়ক এবং রাজ্য নেতাদের টানা তিন দিন থাকার নির্দেশ ছিল। শুভেন্দু তা করেননি। লোকসভা ভোটের বিপর্যয়ের পরে আবার সেই সব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

ঘটনাচক্রে, শুভেন্দু অনেক ক্ষেত্রে ‘সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত’ও নিয়ে থাকেন। যেমন এক নেতার কথায়, ‘‘উনি সংগঠনের কেউ না হলে ভোটের পর আক্রান্তদের নিয়ে রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন কেন? সেটা তো পরিষদীয় দলের কর্মসূচি ছিল না! সেখান থেকেই ২১ জুলাই গোটা রাজ্যে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সংগঠনের কেউ না হলে তা দেন কী করে?’’

দৃষ্টান্ত বলছে, অতীতেও শুভেন্দু রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করার আগেই ধর্মতলায় অমিত শাহের সভা-সহ অনেক দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এক রাজ্য নেতার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘উনি ওই সব ঘোষণা করে ভুল করেননি। তাঁকে সেই স্বাধীনতা দলই দিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনেও অনেক আসনের প্রার্থী বাছাইয়ে তাঁর মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।’’ বস্তুত, লোকসভা নির্বাচনের আগে আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শুভেন্দুকে। কংগ্রেস থেকে কৌস্তভ বাগচি বা তৃণমূলের তাপস রায়কে দলে নেওয়ার সময় নিজেই সে কথা জানিয়েছিলেন শুভেন্দু। ভোটের আগে অন্য দল থেকে কাদের নেওয়া যেতে পারে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় স্তরের কমিটিতে রাজ্যের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন শুভেন্দুই।

গত ১৬ জুলাই বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসলের নেতৃত্বে সল্টলেকের দফতরে একাধিক বৈঠক হয়। বৈঠকে রাজ্য বিজেপির আগামী কর্মসূচি ঠিক হয়েছিল। সেই সব বৈঠকেও শুভেন্দু হাজির ছিলেন না।

তবে শুভেন্দু-অনুগামী এক নেতার বক্তব্য, ‘‘বাংলা বিজেপিতে শুভেন্দুদার মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিক কেউ আছেন কি? তিনি সমালোচনা করলে মন দিয়ে শোনা যেত।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘শুভেন্দুদা যখন জনপ্রতিনিধি হন, বিজেপির এখনকার রাজ্য নেতাদের অনেকের তখন রাজনীতিতে হাতেখড়িও হয়নি! উনি জানেন, কোন বৈঠকে থাকা উচিত, কোনটায় নয়। কোন কথা বলা উচিত, কোনটা নয়। কর্মীদের মনের কথাই উনি কর্মসমিতির বৈঠকে বলেছেন। ওই জন্যই অত হাততালি পড়েছিল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE